স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য ১০ বছর ধরে জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবির চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকরসহ নানা কারণে গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। কিন্তু গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি।
নিয়মিত বৈঠক আর নির্দিষ্ট মেয়াদে কমিটি বিলুপ্ত ও নতুন কমিটি ঘোষণা ধারাবাহিক নিয়মেই চলছে। তবে নতুন প্রজন্মকে সংগঠনে আনার ক্ষেত্রে তাদের পোহাতে হচ্ছে বিপত্তি। তাই খোলস পাল্টে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে ছাত্রশিবির- এমনটাই অভিযোগ ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাদের।
রাজনৈতিক কারণে ২০০৯ সাল থেকে কোণঠাসা চট্টগ্রাম নগর শিবিরের একনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা। তাদের শেষ ভরসা আর অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ প্রায় তিন দশক পর নিজেদের দখলে নেয় এই দুটি কলেজের নেতৃত্ব। এর আগে মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও নিজেদের কর্তৃত্ব হারায় শিবির। তাই বর্তমানে অনেকটা লেজেগোবরে অবস্থা তাদের। তার ওপর হামলা-মামলার ভয়ে প্রকাশ্যে প্রচার-প্রচারণা বা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না তারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে নতুন প্রজন্মশূন্য হচ্ছে এ আশঙ্কায় কৌশল বদলে নেতাকর্মীদের গোপনে নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে ভিড়তে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রমাণও মিলেছে মহানগর শিবিরের সাবেক নেতাকর্মীদের কার্যক্রম ও ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগে।
২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত নিজেকে শিবিরের একনিষ্ঠ কর্মীর পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন চট্টগ্রামের সামাজিক সংগঠনের পরিচিত মুখ বায়েজিদ সুমন। নগরফুলসহ একাধিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে খোলস পাল্টে সামাজিক কার্যক্রমে পোক্ত করেছেন নিজের অবস্থান।
বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরে আলোচিত ও পরিচিত একটি সংগঠন নগরফুল। কোমলমতি পথশিশুদের নিয়ে নগরের প্রায় ৮টি স্পটে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। কিন্তু সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত সবাই শিবিরের একনিষ্ঠ কর্মী বলে অভিযোগ শুরু থেকেই। বুদ্ধিজীবী হত্যামামলার আসামি ও জামায়াত নেতা চৌধুরী মাইনুদ্দীনের সংগঠন মুসলিম এইডের অর্থায়নে নগরফুলের কার্যক্রম শুরু হয়। সেই সূত্র ধরে জয়নিউজের অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও এরসঙ্গে কাজ করা অনেকের শিবির সম্পৃক্ততার প্রমাণ।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন এক সময়কার ইসলামী ছাত্রশিবিরের শীর্ষ কর্মী। এরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খোলস বদলে সামাজিক সংগঠনে সরব হয়েছেন হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে। খোদ সংগঠনটির সভাপতি বায়েজিদ সুমন ও সহসভাপতি সাইফুল ইসলাম ছিলেন শিবির অন্তঃপ্রাণ কর্মী। শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অকপটে স্বীকারও করলেন তারা। তবে তারা এটাকে কেবল এক সময়ের আবেগ হিসেবে দেখছেন।
শুধু বায়েজিদ বা সাইফুল নয়, সংগঠনটির মূল দায়িত্বে থাকা বেশিরভাগ সদস্য একসময়ের শিবিরকর্মী। এরমধ্যে কয়েকজন নারী সদস্যও রয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত অবস্থান পোক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সামাজিক সংগঠনের আশ্রয়ে এরা নগরজুড়ে পোক্ত করেছেন নিজেদের শক্তিশালী বলয়। শুধু চট্টগ্রাম নগর নয়, এর বাইরে কক্সবাজার, কুমিল্লাসহ দেশের আরো কয়েকটি জেলায়ও বিস্তৃত করেছেন তাদের পরিধি। যেখানে সম্পৃক্ত হচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী। যাদের বেশিরভাগই জানেন না সংগঠনের মূল টার্গেট কি বা কোথা থেকে আসছে এর অনুদান। শুধু তাই নয়, সংগঠনের বদৌলতে এরা সুযোগ নিচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের কাছে যাওয়ার। সাড়াও মিলছে ওইসব দিক থেকে।
আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে মঞ্চে আসন গ্রহণেরও সুযোগ হচ্ছে তাদের। কিন্তু কোনো ব্যবসায়িক শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বা আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে অনুদান নেন না বলে জানিয়েছেন বায়েজিদ। জানালেন, অনুদানের অর্থ সংগঠনের পরিচিতজনদের কাছ থেকে আর বিদেশ থেকে আসে।
চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও নগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি লুৎফুল এহছান শাহ জয়নিউজকে বলেন, ইসলামী ছাত্রশিবির স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে স্পর্শকাতর সব বিষয়। কখনো ধর্ম, কখনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ তাদের হাতিয়ার।
তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন শিবির গৃহবন্দি । কিন্তু তারা তাদের কার্যক্রম সচল রাখতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। আর আমাদের দলের নেতারা যাচাই-বাছাই ছাড়া তাদের দলে নিচ্ছেন। এ কারণে আমাদের দলের মধ্যে অন্তর্কোন্দল, সংঘর্ষ ও খুনের মতো ঘটনা ঘটছে। এই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলে ভবিষ্যতে দলের আরো বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেন তিনি।
একাধিক সিনিয়র ছাত্রলীগ নেতার দাবি, এক সময়ের শিবিরের একনিষ্ঠ কর্মীরা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে জড়িয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অবস্থান নিচ্ছে। অনেক নেতার আস্থা অর্জন করে তারা সহজে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করছে। দেশের আনাচা-কানাচে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কমিটিতে শিবির, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা পদ পেয়ে যাচ্ছে। এদের কারণে বঞ্চিত হচ্ছে ছাত্রলীগের প্রকৃত ত্যাগী নেতাকর্মীরা।
সম্প্রতি ঘোষিত ৩০১ সদস্যের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহসভাপতির পদ পেয়েছেন রুহুল আমিন। এই রুহুল আমিন একসময় গাজীপুর কাউলতিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের আরেক নেতা এইচএম তাজউদ্দিন চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ কামিল মাদ্রাসা শাখা শিবিরের বিভিন্ন কমিটির অর্থ সম্পাদক, পাঠাগার সম্পাদক ও ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু খোলস পাল্টে আজ বনে গেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক সহসম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাসেল। চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী হওয়ায় প্রভাবশালী নেতা হিসেবে মিছিল-সমাবেশে সামনের সারিতে থাকতেন সবসময়। তিনিও ছাত্রলীগ কমিটিতে পদ পাওয়ার আগে নগরের বাকলিয়া ওয়ার্ড ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি শিবিরের মিছিল-সমাবেশে সামনের সারিতেই থাকতেন। এ নিয়ে গতবছর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশ পায়।
চবি ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি সুজন জয়নিউজকে বলেন, সিনিয়র নেতাদের অনুরোধে রাসেলের নাম চবি ছাত্রলীগ কমিটিতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত পরে আমরা শিবিরের মিছিলে তার কিছু ছবি পাই। এরপর তাকে বহিষ্কার করতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বরাবর অভিযোগ পাঠাই। বর্তমানে রাসেল ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
চবি ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক সভাপতি আলমগীর টিপু বলেন, রাসেলের শিবির সম্পৃক্ততার প্রমাণ আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে লিখিতভাবে দিয়েছি। কিন্তু কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) জাকারিয়া দস্তগীর জয়নিউজকে বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াত শিবির। পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ পোড়ানোর আন্দোলনের পর থেকে এরা নিজেদের নামে মাঠে আর কোনো কার্যক্রম চালাতে পারছে না। তবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে শিবির তাদের কর্মীদের সামাজিক সংগঠনসহ সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে নামিয়ে দিচ্ছে। এখনো শিবির কর্মীরা নামে-বেনামে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের প্রায় সব ইউনিটে সরব রয়েছে। আর এ অনুপ্রবেশকারী শিবিররা ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের খবর মুহূর্তে জানিয়ে দেয় শিবির নেতাদের। ছাত্রলীগের উচিত এ ব্যাপারে সজাগ হওয়ার।
সর্বশেষ জামায়াত কাঠামো ঠিক রেখে নতুন নামে নতুন সামাজিক সংগঠন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করার দায়িত্ব আনুষ্ঠনিকভাবে দিয়েছে জামায়াত কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদকে। ইতোমধ্যে নতুন সামাজিক সংগঠন করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে পরিষদ।
জয়নিউজ/আরসি