রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালে নগর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক আবদুচ ছালামকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। ১০ বছর দায়িত্ব পালনের পর সম্প্রতি সংস্থাটির চেয়ারম্যান পদ থেকে বিদায় নেন তিনি।
ছালামের মেয়াদে চট্টগ্রামে শুরু হওয়া নানা প্রকল্প, বিশেষ করে ফ্লাইওভার প্রকল্প নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহল, সর্বত্র প্রশ্ন উঠে। কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি।
সিডিএ চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিদায়ের পর তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসছে। অনেকে ছালাম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তদন্তেরও দাবি জানিয়েছেন। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনেও জমা পড়েছে কয়েকটি অভিযোগ।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম
নগরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকার প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। চলতি বছরের শুরুতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
এ প্রকল্পের কাজ পেতে ১০টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়। বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ২ হাজার ৮৫৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় প্রকল্পের কাজ পায় ম্যাক্স র্যা ঙ্কিন জেভি। প্রতিষ্ঠানটি এর আগেও সিডিএ’র একাধিক প্রকল্পের কাজ পেয়েছিল।
তবে সেসময় সিডিএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের বিরুদ্ধে ম্যাক্সকে কাজ পাইয়ে দিতে দরপত্রের শর্তে পরিবর্তন আনার অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়। বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নিয়ে নয়-ছয়
নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত প্রকল্প নিয়ে অনেক আশার কথা শুনিয়েছিলেন আবদুচ ছালাম। এই মেগা প্রকল্পের ‘ক্রেডিট’ ছালাম নিলেও এর কোনো সুফল জনগণ পাচ্ছে না। গত বছর আবদুচ ছালাম বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ২০১৯ সালে নগরবাসী এ প্রকল্পের সুফল পেতে শুরু করবেন। কিন্তু ক’দিন আগেই মাত্র একদিনের বৃষ্টিতে নগরের আরো নতুন নতুন এলাকা ডুবেছে। অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনীকে হস্তান্তর করার আগে প্রকল্পটি নিয়ে অনেক নয়-ছয় করা হয়।
কাজির দেউড়ি বাজারের সাবস্টেশন বদলে ওয়েলফুডের শো-রুম
২০১৭ সালে পুরানো বাজার সরিয়ে কাজির দেউড়ি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স ও কাঁচাবাজার নির্মাণ করে সিডিএ। কমপ্লেক্সটি নির্মাণের পর আবদুচ ছালাম, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন ও বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকে অভিযোগপত্র জমা দেন কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজারের ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা।
এতে দোকান বরাদ্দের নামে লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, চুক্তির তোয়াক্কা না করে টাকার বিনিময়ে এলোমেলো দোকান বরাদ্দ ও কাঁচাবাজারের সাবস্টেশনের জায়গায় দোকান বরাদ্দ দিয়ে ওয়েলফুডের শো-রুম স্থাপনসহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়।
শেষবেলায় ১০ কোটি টাকার প্লট পাঁচ অনুচরের হাতে
সিডিএতে নিজের মেয়াদের শেষদিকে এসে ১০ কোটি টাকা মূল্যের প্লট পাঁচ অনুচরের হাতে তুলে দেন আবদুচ ছালাম। শুধু তাই নয়, পুরো মেয়াদেই তাঁর বিরুদ্ধে প্লট বরাদ্দ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল নানা মহলের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ৩১ মার্চ সিডিএ’র কল্পলোক ও অনন্যা আবাসিক এলাকার পাঁচটি প্লট বরাদ্দ দেন আবদুচ ছালাম। তখন প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় ছালামের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত সিডিএ’র দুই বোর্ড সদস্য কেবিএম শাহজাহান ও জসিম উদ্দিন শাহকে। এছাড়া আবদুচ ছালামের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) তারেক গণির মা জাকিয়া বেগম, চেয়ারম্যানের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ওয়েল গ্রুপের জনসংযোগ কর্মকর্তা সেতু বড়ুয়া ও সাংবাদিক হামিদ উল্লাহ নামের অপর এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে তিনটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। চলতি বাজারমূল্যে এসব প্লটের দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা।
‘অনুগতদের’ পদোন্নতি
সিডিএ চেয়ারম্যানের দায়িত্বগ্রহণের পর কোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেননি আবদুচ ছালাম। তবে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে বিদায় নেওয়ার তিনদিন আগে সিডিএ’র বোর্ডসভায় একসঙ্গে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
সিডিএ’র বোর্ড মেম্বার কেবিএম শাহজাহান জানান, ১৮ এপ্রিলের বোর্ডসভায় যোগ্যতা ও প্রাপ্যতার ভিত্তিতে ৮০ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
উদ্বোধনের আগেই আউটার রিং রোডে ধস
গত ১৩ জুলাই পতেঙ্গা আউটার রিং রোডের ওয়াকওয়ের কয়েকটি অংশ উদ্বোধনের আগেই ধসে পড়ে। এ ঘটনায় নগরবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ওয়াকওয়ে ধসের ঘটনায় সিডিএ’র অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে এখানেও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সিডিএ।
ছালামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তদন্তের দাবি
গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইন্দু নন্দন দত্ত। তিনি সিডিএ’র বিদায়ী চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ও তাঁর স্বজনদের ব্যাংক একাউন্ট যাচাইয়েরও আহ্বান জানান।
গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব চত্বরে ‘চট্টগ্রাম নাগরিক উদ্যোগ’ আয়োজিত মানববন্ধন ও সমাবেশে অংশ নিয়ে ১৪ দলীয় জোটের নেতা ইন্দু নন্দন দত্ত এ দাবি জানান।
বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণকাজে গাফিলতি
২০১২ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে ১৫ জন নিহত হন। আহত হন অনেকে। সেসময় বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, ফ্লাইওভার নির্মাণের পদ্ধতিগত ত্রুটি, ঠিকাদারের গাফিলতি, সঠিক তদারকিতে দুর্বলতা ও উপযুক্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়াতেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর আগে আরো দু’বার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এর থেকে সিডিএ কোনো শিক্ষা নেয়নি। কর্তৃপক্ষ এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সতর্ক হলে এ ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক কমে যেত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম
বৃহত্তর বাকলিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ২২১ কোটি টাকা ব্যয়ে চলছে বাকলিয়া এক্সেস রোডের নির্মাণকাজ। দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ও চার লেইনের এই সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে বাকলিয়া এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হবে।
কিন্তু এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণে ছিল নানা অনিয়ম। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, মূল মালিকদের কম টাকা দিয়ে সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনদের নামে জায়গাগুলো নেওয়া হয়। পরে বেশি দামে সেসব জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়।
পাহাড় কেটে মার্কেট তৈরিতে সমর্থন
নগরের গোলপাহাড় মোড়ে পাহাড় কেটে নির্মিত হয়েছে ইমপালসের একটি মার্কেট। মার্কেটটিতে পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধিতা সত্ত্বেও মার্কেটটি তৈরির অনুমতি দেন আবদুচ ছালাম। অভিযোগ রয়েছে, সিডিএ’র বোর্ড সদস্য গিয়াস উদ্দিন ও আবদুচ ছালাম কারসাজি করে এ মার্কেটটি তৈরি করেন।
আবাসিক এলাকায় নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
আইন অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ভবন তৈরির নিয়ম নেই। সেই আইনের তোয়াক্কা না করে নিজে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান থাকাকালীন নগরের ও আর নিজাম রোড এলাকায় গড়ে তোলেন ওয়েল পার্ক নামে চার তারকামানের একটি হোটেল। এটি নিয়েও সমালোচনা রয়েছে বিভিন্ন মহলে। এ নিয়ে ওই সময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি আইন সংশোধনের চেষ্টা করেন।
এ বিষয়ে জানতে সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামকে ফোন করা হলে তিনি জয়নিউজকে বলেন, ‘ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি শতভাগ স্বচ্ছতার মধ্যে কাজ করার জন্য।’
জলাবদ্ধতা প্রকল্প নিয়ে ছালাম বলেন, ‘প্রকল্পটি এখন সেনাবাহিনীর হাতে। আমি কিছু জানি না।’
অন্যান্য বিষয়ে তাঁর (ছালাম) দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলম জয়নিউজকে বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও কাজির দেউড়ি বাজারের বিষয়ে আমাদের কাছে কয়েকজন অভিযোগ করেছেন। যদি অন্য বিষয়গুলোতেও অভিযোগ পাই, আমরা তদন্ত করে দেখব।’