শাখাওয়াত হোসেন। বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। আর মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে চালান সংসার। সংসারের দারিদ্র্যতা দূর করতে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন শাখাওয়াত। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন গালফকো-অপারেশন কাউন্সিল অ্যাপ্রুভড মেডিকেল সেন্টারস অ্যাসোসিয়েশন (গামকা)।
মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সব ঠিক করলেই বিদেশ যেতে পারবেন শাখাওয়াত। এমনটাই জানান তিনি। কিন্তু তার পাসপোর্ট ও ভোটার আইডি কার্ডে বয়স ঠিক থাকলেও গামকা মনোনীত আগ্রাবাদ মেডিকেয়ার মেডিকেল সেন্টারের বক্তব্য- পাসপোর্ট ও ভোটার আইডি কার্ডের বয়স ভুয়া!
জানা যায়, মেডিকেল চেকআপের প্রথমদিন তার (শাখাওয়াত) রক্ত, বুক ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা শেষে রিপোর্ট নিতে চারদিন পর আসতে বলা হয়। এরপর রিপোর্ট নিতে গেলে মেডিকেয়ারের রিসিপশনে থাকা কর্মকর্তা রিপোর্ট দিতে অপারগত প্রকাশ করে। কারণ হিসেবে বলে, এই ভিসার জন্য বয়স হয়নি শাখাওয়াতের। তাই এবার বয়স টেস্ট করতে হবে।
মেডিকেল চেকআপে শরীরে কোনো সমস্যা না থাকার পরও অহেতুক হয়রানি করছে মেডিকেয়ার কর্তৃপক্ষ, দাবি শাখাওয়াতের। তিনি জয়নিউজকে বলেন, আমি আমার এক মামার সহায়তায় ওমানে একটা কাজের ভিসা পাই। ভিসায় নূন্যতম বয়সের প্রয়োজন ছিল ২২ বছর দুই মাস। আমার ভোটার আইডি কার্ড ও পাসপোর্টে বয়স ২৩ বছরেরও বেশি। তাই আমি ওই ভিসায় ওমান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
তিনি বলেন, মেডিকেল টেস্ট করতে মেডিকেয়ার মেডিকেল সেন্টারে আসি। টেস্ট দেওয়ার পর তারা জানায়, আমার শরীরে কোনো সমস্যা নেই। তবে রিপোর্ট দেওয়া যাবে না উল্লেখ করে তারা বলে, আমার বয়স হয়নি। বয়সের টেস্ট করতে হবে।
শাখাওয়াত বলেন, তাদের আমি অনেক অনুরোধ করে বলি, যা করার করেন। ভিসার ডেইট চলে গেলে আমার আর বিদেশ যাওয়া হবে না। আমার বয়স ঠিক থাকার পরেও উনারা আমাকে এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে ঘুরিয়েছেন। বারবার অনুরোধ করার পরও তারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন।
শুধু শাখাওয়াত নন, এমন হয়রানির শিকার আরো অনেকে। কয়েকজন বিদেশগামী ব্যক্তি জয়নিউজকে জানান, দালাল ছাড়া এখানে যারা আসে তাদের বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে হয়রানি করা হয়। যাতে দালালদের মাধ্যম হয়ে আসতে হয়। এতে তাদের কিছু বাড়তি আয় হয়।
ড্রাইভিং ভিসায় সৌদিআরবে যাওয়ার উদ্দেশে মেডিকেয়ার মেডিকেল সেন্টারে টেস্ট করতে আসেন রাউজানের মোস্তাফিজুর। তিনি জয়নিউজকে বলেন, এখানে এজেন্সি আর দালাল ছাড়া আসলে এমনই হয়। আমি এজেন্সির মাধ্যমে এসেছি। প্রথমে আমার সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ১৫ হাজার টাকা। তারা আমাকে বলেছে, মেডিকেয়ার হাসপাতালে টেস্ট দিতে আসতে হবে না। আমার সব টেস্টে ফিট করে দেবে তারা। কিন্তু আমি ওই চুক্তিতে যাইনি। ১০ হাজার ৫০০ টাকার চুক্তিতে এখানে টেস্ট দিতে এসেছি। যদিও কাগজে-কলমে ৮ হাজার ৫০০ টাকা লেখা।
এ বিষয়ে কথা বলতে মেডিকেয়ার মেডিকেল সেন্টার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
তবে কর্তব্যরত স্টাফরা জানান, যা বলার তাদের বলতে। সাংবাদিক কিংবা বাইরের কারো সঙ্গে কথা বলেন না কর্তৃপক্ষ। তবে অনেকক্ষণ তর্ক-বিতর্কের পর ডাক্তারের রুমে যাওয়ার অনুমতি মিলে।
অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডা. শাওলী বড়ুয়া বলেন, পাসপোর্ট করার সময় সব দুই নাম্বারি হয়। টাকা দিলে সব করা যায় সেখানে। ভোটার আইডি ও পাসপোর্টের বয়স দিয়ে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা আমাদের মেতো মেশিনে পরীক্ষা করে বয়স টেস্ট করি।
শাখাওয়াতের পরীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে ইচ্ছুক না।
মেডিকেয়ার মেডিকেলের প্রধান চিকিৎসক বা ম্যানেজমেন্টের কেউ আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছেন এটাই অনেক। এখানে আর কারো সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
পাসপোর্টের বয়স নিয়ে ডা. শাওলীর মন্তব্যের বিষয়ে মনছুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক উত্তম কুমার দেব জয়নিউজকে বলেন, এই কথা যদি তিনি বলে থাকেন, তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে অবমাননা করেছেন। কেননা আমরা পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিনিধি দিয়ে করা জন্ম নিবন্ধন ও ভোটার আইডি কার্ডের কপি যাচাই-বাছাই করে পাসপোর্ট দিয়ে থাকি। সেক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসকে দোষ দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে তাদের এমন কোনো অভিযোগ যদি থাকে, তাহলে লিখিতভাবে আমাদের জানালে আমরা ব্যবস্থা নিব।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসার মো. হাসানুজাম্মান জয়নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র বর্তমানে পৃথিবীর এক নাম্বার না হলেও সেরা পাঁচের মধ্যে থাকবে। কেননা পর্যাপ্ত তথ্য নিয়ে নির্ভুলভাবে প্রত্যেক নাগরিককে তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এখানে ভুল তথ্য বা ভুয়া বয়স আসার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে কেউ যদি জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে এমন মন্তব্য করেন তা দুঃখজনক।
এতকিছুর পরও পুনরায় মেডিকেয়ার মেডিকেল সেন্টারে বয়সের টেস্ট দেন শাখাওয়াত। ফলাফলে আসে, ভোটার আইডির বয়সই সঠিক তার। অর্থাৎ ২৩ বছরেরও বেশি বয়স শাখাওয়াতের। কিন্তু এতদিনে তার ভিসার মেয়াদ শেষ। এমতাবস্থায় এক মেডিকেয়ারের খামখেয়ালিপনায় আর বিদেশ যাওয়া হয়নি তার।