লালখানবাজার ওয়ার্ডের তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর এ এফ কবির আহমদ মানিক। তার বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখল, অবৈধ ভবন নির্মাণ, অর্থ আত্মসাৎসহ রয়েছে অনেক অভিযোগ। এরমধ্যে কয়েকটির তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এবার তার বিরুদ্ধে উঠেছে স্কুলের শিক্ষক ও আয়ার বেতন আত্মসাতের অভিযোগ! সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাচ্ছেন জয়নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহাদাত রিফাত
নগরের ইস্পাহানি মোড় থেকে মতিঝর্ণা লেইনে ঢুকতেই চোখে পড়বে একটি দুইতলা মার্কেট। সবাই লালখানবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মার্কেট বা স্কুল মার্কেট হিসেবে চিনলেও ভাড়া বাবদ কোনো টাকা পায় না স্কুল কর্তৃপক্ষ। ভাড়ার পুরো টাকাটাই যায় কাউন্সিলর এ এফ কবির আহমদ মানিকের পকেটে!
স্থানীয়দের দাবি, মার্কেট নির্মাণের সময় মানিক বলেছিলেন ভাড়ার টাকা জমা হবে স্কুল ফান্ডে। সেই টাকায় স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও আয়াদের বেতন দেওয়া হবে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খণ্ডকালীন শিক্ষক ও আয়ার বেতনের নাম দিয়ে স্কুলের জমি ও সিটি করপোরেশনের নালার উপর অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয় মার্কেট। মার্কেটটি নির্মাণের সময় স্থানীয়রা প্রতিবাদ করেছিলেন। তৎকালীন মেয়র এম মনজুর আলমের দ্বারস্থও হয়েছিলেন তারা। তবে লাভ হয়নি।
স্থানীয়দের বক্তব্য, সাংসদ ডা. আফছারুল আমিনের অনুসারী পরিচয় দিয়ে সেসময় পার পেয়ে গিয়েছিলেন মানিক। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত মেয়র মনজুর আলমও কোনো ব্যবস্থা নেননি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেসময় সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম মনি ও স্থানীয়দের চাপে কাউন্সিলর মানিক বলেছিলেন শিক্ষক ও আয়ার বেতনের জন্য মার্কেটটি নির্মাণ করা হচ্ছে। লোক দেখানোর খাতিরে ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষক ও আয়ার বেতনের টাকাও দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে হঠাৎ করে বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেন তিনি।
স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থাকার পর বার-বার যোগাযোগ করা হলেও মানিকের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। একসময় সাফ জানিয়ে দেন তিনি বেতন দিতে পারবেন না। একে নিজে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, তারউপর স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিও তার বিশ্বস্ত হওয়ায় কারও কিছু করার ছিল না।
তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ খণ্ডকালীন ওই শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রায় ৬ মাসের বেতন বকেয়া রেখে তাদের ছাটাই করতে বাধ্য হয়। যাদের টাকা এখনও বকেয়া রয়ে গেছে।
বেতন বকেয়া থাকা শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে সাজেদা পারভীন, ফাতেমা ফেরদৌসী, সুমি আক্তার, ইয়াসমিন শাহরিয়ার মিমি ও সুমি দেবের নাম জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে স্কুলের প্রাক্তন খণ্ডকালীন শিক্ষক সুমি দেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জয়নিউজকে বলেন, ‘ছাত্রী থাকা অবস্থায় পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য আমি ওই স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকেসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও আয়াকে ছয়মাসের বেতন বকেয়া রেখে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়। আমরা এখনও ওই ছয়মাসের বেতন পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘শুনেছি কাউন্সিলর মানিক স্কুলের নাম দিয়ে যে মার্কেট করেছেন সেখান থেকে আমাদের বেতন দিতেন। তিনি টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছিলেন হেডস্যার।’
এ বিষয়ে কথা হয় লালখানবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজাদ ইকবালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কাউন্সিলর মানিক সাহেব খণ্ডকালীন শিক্ষক ও আয়ার বেতন বাবদ প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতেন। স্কুল মার্কেটের ভাড়া থেকে এ টাকা দেওয়া হতো বলে শুনেছিলাম। কিন্তু পরে উনি টাকা দিতে পারবেন না বলায় আমরা শিক্ষক ও আয়াদের বাদ দিতে বাধ্য হই।’
আজাদ ইকবাল বলেন, ‘মানিক সাহেব টাকা না দেওয়ার কারণে ছয়মাস তাদের বেতন দিতে পারিনি। একসময় তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হই। তারা এখনও ছয়মাসের বেতন পাবে, যার নথি আমার কাছে আছে।’
আরও পড়ুন: কাউন্সিলর মানিক: দখল-আত্মসাতে অবৈধ সম্পদের পাহাড়!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলের এক শিক্ষক জয়নিউজকে বলেন, ‘একসময় মানিক সাহেব স্কুল মার্কেটের ভাড়া থেকে খণ্ডকালীন শিক্ষকদের বেতন দিতেন। কিন্তু একসময় তাও বন্ধ করে দেন। আজ অবধি স্কুল ফান্ডে মার্কেটের কোনো টাকা জমা পড়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। অথচ সবাই এটিকে স্কুল মার্কেট নামেই চেনে!’
স্কুল মার্কেটে থাকা ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী কাজল দাশ জয়নিউজকে বলেন, ‘আমরা ২০১৩ সালে তিন লাখ টাকা সেলামি দিয়ে দোকান নিয়েছি। ভাড়া মাসে চার হাজার টাকা। সেলামির টাকা কাউন্সিলর মানিকের সহযোগী মহসিনকে দিয়েছি। ভাড়ার টাকাও তাকেই দিই।’
মার্কেটের অপর ব্যবসায়ী মো. হানিফ জয়নিউজকে বলেন, ‘আমি গত রমজান মাসে চার লাখ টাকা সেলামি দিয়ে মাসুম মোল্লা থেকে দোকান নিয়েছি। মাসে আট হাজার টাকা করে ভাড়া দিচ্ছি। কিন্তু এখন শুনি এই মার্কেট অবৈধ। তাই আমি দোকান ছেড়ে দিচ্ছি।’
কথা হয় মাসুম মোল্লার সঙ্গেও। ভাড়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘কাউন্সিলর মানিককে টাকা দিয়ে সেলামির মাধ্যমে দোকানটি নিয়েছি।’
সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি আর কিছু বলতে চাননি।
এ বিষয়ে কাউন্সিলর মানিকের বিশ্বস্ত সহযোগী মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জয়নিউজকে বলেন, ‘আমি কেন ভাড়া নিব! মার্কেট কার তা আমি জানি না। আর এসব বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে পারব না। দুদক আমাদের ডেকেছে, আমরা জবাব দিয়ে এসেছি।’
লালখানবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কাজী মাহমুদ ইমাম বেলু জয়নিউজকে বলেন, ‘মার্কেটটিকে সবাই স্কুল মার্কেট হিসেবেই চেনে। তবে এই মার্কেট থেকে কোনো টাকা স্কুল পায় না। তাছাড়া আমি ২০১৮ সালে কমিটির সভাপতি হয়েছি। তাই আমি মার্কেট নিয়ে তেমন কিছু জানি না।’
চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য ডা. আফছারুল আমিন জয়নিউজকে বলেন, ‘অনেকদিন আগের কথা, তাই সব মনে পড়ছে না। তবে দেখে আমার কাছে মনে হয়েছিল মার্কেটটি নির্মিত হয়েছে করপোরেশনের নালার উপর। আমি ভেবেছি মানিক কাউন্সিলর, তাই করপোরেশনের জায়গায় মার্কেট নির্মাণ করেছেন। এখন জানলাম অর্ধেক জায়গা স্কুলের। সেক্ষেত্রে মানিককে জিজ্ঞেস করেন স্কুলকে তিনি কেন টাকা দিচ্ছেন না।’
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে মানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি না।’