চলমান অভিযানের মধ্যে জুয়া ও ক্যাসিনোর ব্যাপারে বক্তব্য দিয়ে সারাদেশে সমালোচিত হয়েছেন হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী। শুধু নিজের নয়, ছেলের কর্মকাণ্ডেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন তিনি।
সারাদেশে যখন হুইপ সামশুল ও তার ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী সারুনকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে ঠিক তখনই চট্টগ্রামে বড় রকমের শোডাউন করেছে বাপ-বেটা।
শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিমানযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসেন হুইপ ও তার ছেলে। বিমানবন্দরে আগে থেকেই তিন হাজারের মতো নেতাকর্মীর অবস্থান ছিল। এসময় পটিয়া থেকে আগত নেতাকর্মীদের হাতে দেখা যায় বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড। যেখানে লেখা ছিল ‘সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দাও’।
আরও পড়ুন: হুইপপুত্রের অস্ত্রের মহড়া (ভিডিওসহ)
বিমানবন্দরে পৌঁছার পর সামশুল হক চৌধুরী খোলা জিপে ওঠেন। এসময় চার শতাধিক মোটরসাইকেল, দুই শতাধিক হাইচ-মাইক্রো ও অর্ধশত বাস নিয়ে তার সমর্থকদের বিশাল শোডাউন পটিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয়। এই শোডাউনের কারণে বিমানবন্দর এলাকায় যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েন।
কামাল উদ্দিন নামে এক পথচারী জয়নিউজকে বলেন, শোডাউন করার কি আছে। চোরের মার বড় গলা। তিনি কি বিশেষ কিছু অর্জন করেছেন যে এভাবে শোডাউন করতে হবে। শোডাউন করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে তারা।
এ নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঝে। বিষয়টিকে অপরিপক্ক রাজনীতির ফসল হিসেবে উল্লেখ করে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান জয়নিউজকে বলেন, তিনি (সামশুল হক) হাইব্রিড নেতা। এসব নেতাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মন্তব্যের কারণে আমরা হতবাক-বিব্রত। তাদেরকে চিহ্নিত করার সময় এসেছে।
আরও পড়ুন: আ’লীগে অনুপ্রবেশকারীরাই ক্যাসিনো কাণ্ডে জড়িত!
সামশুল হক চৌধুরী সম্পর্কে দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, আশির দশকে সামশুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম নগরের আমতলা এলাকার হকার ছিলেন। হকার থাকাকালীন তিনটি টাইপ মেশিন চুরির অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। ১৯৮০ সালের আগস্টে চুরি করা টাইপ মেশিনসহ সামশুলের গ্রেপ্তারের ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এরপর তিনি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে হকার থেকে যুবদলে যোগ দেন। এসময় নগরের ডবলমুরিং থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। পরে জাতীয় পার্টির আমলে সুগন্ধা আবাসিকে প্লট বিক্রির নামে তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। ওই সময় তিনি রিয়াজউদ্দিন বাজারে নালার ওপর একটি মার্কেট গড়ে তোলেন। এরপর তিনি যুব সংহতিতে যোগ দেন।
১৯৯৯-২০০০ সালে এক শিল্পপতির হাত ধরে চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। আবাহনী লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার পর চারদলীয় জোট সরকারের আমলে লন্ডনে ফুটবল দল নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ ওঠে। ওই সময় সরকার ২২ জনের দল নেওয়ার অনুমতি দিলেও আরো ১৫ জন বেশি নিয়ে যান তিনি। এই অনিয়মের কারণে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন সামশুল।
আরও পড়ুন: হুইপের বিরুদ্ধে ১৮০ কোটি টাকা আয়ের অভিযোগ আনা সেই পরিদর্শক বরখাস্ত
২০০৭ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ লীগ অংশগ্রহণের আগে ফিফার গাইডলাইন অনুযায়ী নগরের জিইসি মোড়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, ওই অ্যাকাউন্টে তিনজনের নাম থাকলেও তৎকালীন সভাপতি দিদারুল আলমকে বাদ দিয়েই সামশুলসহ দুজন টাকা উত্তোলন করেছেন। বিষয়টি দেড় মাস আগে জানার পর দিদারুল আলম ওই ব্যাংকে অভিযোগ করে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেন।
এখানেই শেষ নয়। সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে, বিদেশে অর্থপাচার, কয়েক বছরে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। প্রতিদিন আবাহনী ক্লাব থেকে পাঁচ লাখ টাকা এবং বছরে মাঠ ভাড়া দিয়ে কোটি টাকা অবৈধ আয় করেন তিনি।
সামশুল হক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংসদ সদস্য হওয়ার আগে পটিয়ায় নিজগ্রামে টিনের একটি একচালা ঘর ছিল তার। দোতলা একটি বাড়ি ছিল নগরের হালিশহরে। কিন্তু ২০০৮ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য হওয়ার পর বাড়িটি চারতলা করেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পর দুই কোটি টাকার বেশি খরচ করে বিলাসবহুল একটি বাড়ি করেন।
নগর থেকে পটিয়ায় যাওয়ার পথে কর্ণফুলী উপজেলার ভেল্লাপাড়া এলাকায় প্রায় দুই একর জায়গাও কিনেছেন তিনি। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তার একটি মাইক্রোবাস ছিল। এখন তার তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। এছাড়াও নগরীতে বহুতল একটি বাণিজ্যিক ভবনও রয়েছে সামশুল হক চৌধুরীর।
এসব বিষয়ে জানতে হুইপ সামশুল হক চৌধুরীকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
আরও পড়ুন: হুইপ সামশুলকে লিগ্যাল নোটিশ
এর আগে রোবাবর (২২ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে সংবাদকর্মীদের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী।
আবাহনীসহ কয়েকটি ক্লাবে র্যাবের অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন— ‘চট্টগ্রামে শতদল, ফ্রেন্ডস, আবাহনী, মোহামেডান ও মুক্তিযোদ্ধাসহ ১২টি ক্লাব আছে। ক্লাবগুলো প্রিমিয়ার লীগে খেলে। ওদের তো ধ্বংস করা যাবে না। খেলাধুলাও বন্ধ করা যাবে না। প্রশাসন কি খেলোয়াড়দের পাঁচ টাকা বেতন দেয়? ওরা কিভাবে খেলে, টাকা কোন জায়গা থেকে আসে, সরকার কি ওদের টাকা দেয়? দেয় না। এই ক্লাবগুলো তো পরিচালনা করতে হবে।’