এ যেন আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে চলছে সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও বিক্রি। এর আগে মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তামাকজাত পণ্য বিক্রি বন্ধে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এক আদেশ জারি করা হয়। আর ৮ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানকে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়।
এই বিষয়ে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এরপরও তামাক কোম্পানির দৌরাত্ম্য দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের দৌরাত্ম্যের সামনে ২০০৫ এবং ২০১৩ সালে (সংশোধিত) তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনসহ আরো বিভিন্ন উদ্যোগও মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে কি এসব তামাকজাত কোম্পানিগুলো আইনের চেয়েও বেশি শক্তিশালী? নাকি উদ্যোগ গ্রহণের পর তা বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি। কারণ প্রশ্নের উত্তরেই থাকবে নতুন প্রজন্মের জন্য সুশৃঙ্খল জীবনের সমাধান, থাকবে কেমন ভবিষ্যৎ আমরা তাদের সামনে রাখতে চাই তার উত্তর।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নেওয়া একটি উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসা লাভ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ গজের মধ্যে তামাকজাত পণ্যের বিক্রি বিতরণ নিষিদ্ধ করার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায় শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক সমাজ। ২০১৯ সালের ৪ই সেপ্টেম্বর পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একশ গজের মধ্যে তামাকজাতপণ্যের দোকান অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এতদ্বারা সব তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতা ও পৃষ্ঠপোষকদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, চট্টগ্রাম মহানগরীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে কোনো প্রকার তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়, বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালানো যাবে না। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (২০১৩ সালের সংশোধনীসহ) এর বিধানমতে এসব কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতা ও পৃষ্ঠপোষকদের ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এর মধ্যে সব তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়, বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা বন্ধ করার নিদের্শ দেওয়া গেল। অন্যথায় উল্লেখিত তারিখের পর করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জেল-জরিমানাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে সবার সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, কড়া হুঁশিয়ারিসহ বন্ধের সর্বাত্মক নির্দেশ থাকলেও বন্ধ হয়নি তামাকজাত পণ্যের বিক্রি, প্রদর্শন ও বিতরণ। দেখা গেছে তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও বিভিন্ন উপায়ে তামাকের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরে বিটার তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রমোশনের উপর চালানো একটা জরিপে দেখা গেছে, সাইনবোর্ড, স্টিকার ও ব্যানারের মাধ্যমে ৭৫.৭৬ শতাংশ বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। ডামি প্যাকেট, খালি প্যাকেট দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হয় ৬৩.০৮ শতাংশ। ৫৫.৭৪ শতাংশ তামাক পণ্য বিক্রয়ের বক্স, শোকেজ।
বিভিন্ন কাঠামোর উপর তামাক ব্র্যান্ডের ছাপ দিয়ে ৪৩.৭৩ শতাংশ, ডিসকাউন্ট, লিফলেটের মাধ্যমে যথাক্রমে ৩.৩১ এবং ৩.০৮ শতাংশ বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, প্রচার ও প্রসার করা হয়ে থাকে। যেখানে এইসব বিজ্ঞাপনের প্রচারে দেশে শাস্তিমূলক আইনের উল্লেখ আছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫নং ধারার ১নং উপধারায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনো বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোনভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না।’ এবং ৫নং ধারার ৪নং উপধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি এই ধারার বিধান লংঘন করলে তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
তবে তামাকমুক্ত চট্টগ্রাম নগরী গড়তে সিটি করপোরেশন বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশন একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ওয়ার্কিং কমিটিতে রয়েছে। এখানে ওয়ার্কিং কমিটি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-৫ এর বাস্তবায়নের তারা বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, তামাক কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ গজের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
ট্রেড লাইন্সেসের আওতায় আনা, ট্রেড লাইন্সেস নবায়ন ও প্রদানের ক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রেণ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা গ্রহণ করা উল্লেখ্যযোগ্য। এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে। পাশাপাশি তামাকমুক্ত চট্টগ্রাম নগরী গড়তে জনসম্পৃক্ততা তৈরিতে নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিটা, ক্যাব ও ইলমা। তারা বিশ্বাস করে এই সাংস্কৃতিক কার্যক্রম মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরিতে সাহায্য করবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেখানে তামাক ব্যবহার রোধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে, সেখানে লক্ষ্য স্থির করার পড়েও আমাদের এভাবে পিছিয়ে থাকা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সম্প্রতি পাশের দেশ ভারত, জাপান টোব্যাকোকে বিনিয়োগ করতে দেয়নি, সেখানে আমাদের দেশে টোব্যাকো খাতে জাপানের বিশাল বিনিয়োগ হয়তো দেশের অগ্রযাত্রার পথে হতাশা তৈরি করে।
কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার। কিন্তু ঘোষণা দেওয়ার পরেও তামাক ব্যবহার রোধে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। যার ফলস্বরূপ তামাক কোম্পানিগুলো অনেকটা স্বস্থির সঙ্গেই ধূমপান ও তামাকের প্রসারের যত যা করা সম্ভব তাই করছে। তামাক কোম্পানির কূটকৌশলের কাছে যেন জিম্মি হয়ে আছে সবকিছু।
ধূমপায়ীর দিক দিয়ে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম, যেখানে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে। এমন উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান ও আশংকার মধ্যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই পারে নতুন প্রজন্মকে আশ্বস্থ করতে। যেখানে বিষাক্ত নিঃশ্বাসের নীল বিষে হৃদয় পুড়ে না। বিষাক্ত ধোঁয়ার করাল গ্রাসে হ্রাস পায় না প্রাণশক্তি।
লেখক: প্রধান নির্বাহী- ইলমা।