জুমের ফসল ঘরে তোলায় ব্যস্ত বান্দরবানের পাহাড়ি জুমিয়ারা। কেউই বসে নেই ঘরে। সকলে জুমের ধান কাটতে নেমেছে জুমক্ষেতে। ফসল ঘরে তোলার আনন্দে পাহাড়ি পল্লীগুলোতে চলছে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি। এ বছর আশানুরূপ ভালো ফলন হয়েছে দাবি তাদের।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছর জেলায় প্রায় ৮ হাজার ৯৮৮ হেক্টর জমিতে জুম চাষ করা হয়েছে। গতবছর চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ৯৬৭ হেক্টর জমিতে। ২০১৬ সালে ৮ হাজার ৯৩৭ হেক্টর জমিতে এবং ২০১৫ সালে জুম ৯ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে এ চাষ হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর বান্দরবান জেলায় জুম চাষ বেড়েছে ২১ হেক্টর জমিতে। এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৭৩৫ মেট্রিক টন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ভবতোষ চক্রবর্তী বলেন, জেলায় প্রতিবছর জুমের চাষ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত তিন বছরের হিসাবে দেখা গেছে, ২১ হেক্টর থেকে ৩০ হেক্টর পর্যন্ত জমিতে প্রতিবছর জুম চাষ বাড়ছে। এ বছর জুমের বাম্পার ফলন হয়েছে। জুমের ধান কেটে ঘরে তুলতে শুরু করেছে জুমিয়ারা। এই চাষ থেকে জুমিয়ারা সারা বছরের খাদ্য সংরক্ষণ করে।
জানা গেছে, প্রতিবছর জেলার বিভিন্নস্থানে শত শত পাহাড় আগুনে পুড়িয়ে জুম চাষ হয়। জুমিয়ারা পাহাড়ে ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, মরিচ, যব, সরিষা, মিষ্টি কুমড়া, মারফা, টকপাতা, ফুলসহ বিভিন্ন রকমের সবজি উৎপাদন করে। তবে একটি পাহাড়ে একাধিকবার জুম চাষ করা যায় না বলে জুমিয়ারা প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ে জুমের চাষ করে। জেলায় বসবাসরত ম্রো, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমী, লুসাই, চাকমা, পাংখো, বম, চাক’সহ ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। জেলা শহরে বসবাসরত কিছু শিক্ষিত পরিবার ছাড়া দুর্গমাঞ্চলের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বসবাসরত আদিবাসীরা আজও জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে এই ১১টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ম্রো সম্প্রদায় আদিকাল থেকে এখনো পর্যন্ত জুম চাষের মাধ্যমেই সারা বছরের জীবিকা সংগ্রহ করে।
জুমিয়া পরিবারগুলো প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন লাগায়। আর মে-জুন মাসের দিকে আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে জুম চাষ শুরু করে। প্রায় ৩/৪ মাস পরিচর্যার পর সেপ্টেম্বর মাস থেকে পাহাড়ে জুমের ধান কাটা শুরু করে জুমিয়ারা। জুমের পাকা ধান ও উৎপাদিত অন্যান্য ফসল ঘরে তুলতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে তারা। বান্দরবানের রুমা, থানছি, রোয়াংছড়ি, আলীকদম, লামা উপজেলা এবং ট্যুরিস্ট স্পট নীলাচল, নীলগিরি-চিম্বুক সড়কের রাস্তার দু’পাশের পাহাড়গুলোতে এখন শোভা পাচ্ছে জুমের সোনালী ধান। জুমের পাকা ধানের গন্ধে মাতোয়ারা এখন পাহাড়ি জনপদ।
চিম্বুক সড়কের ম্রোলং পাড়ার জুমচাষী মেনুলু ম্রো, রিংরাং ম্রো বলেন, এ বছর জুমের আশানুরূপ ভালো ফসল হয়েছে। পাহাড়ে প্রায় পাঁচ-সাত একর জমিতে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি লাগিয়েছি।
ওয়াইজংশন পাড়ার জুমচাষী মাংরি ম্রো বলেন, আগাম লাগানো জুম ক্ষেতের ধান পেকেছে। কিন্তু যারা একটু দেরিতে চাষ করেছিল, তাদের ক্ষেতের ধান এখনো পাকেনি। তবে জুমের খুবই ভালো ফলন হয়েছে এবার। ফসল ঘরে তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতিও চলছে পাহাড়ের গ্রামগুলোতে।
স্থানীয় ম্রো সম্প্রদায়ের লেখক ও গবেষক সিইয়ং ম্রো বলেন, জুমচাষ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটি আদি চাষাবাদ পদ্ধতি। এটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ক্ষতিকারক হলেও, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের অংশ। অবশ্য জুম চাষ লাভজনক না হওয়ায় এখন অনেকে জুম চাষ ছেড়ে মিশ্র ফল চাষের দিকেই ঝুঁকছে।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বান্দরবানের উপ-পরিচালক মো. আলতাফ হোসেন জানান, জুমে উৎপাদিত ফসল এ অঞ্চলের খাদ্য চাহিদার অনেকটাই পূরণ করে। তবে আদি পদ্ধতিতে জুম চাষের কারণে পাহাড়ের ক্ষয় এবং জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ আরো বাড়বে। সেই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাও সম্ভব হবে। এজন্য জুম চাষীদের নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
জয়নিউজ/আরসি