রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপি বলেছেন, হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হবে। ফলে এটি রক্ষণাবেক্ষণ এবং তদারকির দায়িত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই হালদা নদীকে রক্ষায় এখন প্রয়োজন পরিকল্পিত পরিকল্পনা। পরিকল্পনা ছাড়া দেশের গর্বের এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই হালদা নদী রক্ষায় কঠোর মনিটরিং করতে প্রয়োজনে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে।
‘হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণাঃ বর্তমান অবস্থা ও সংরক্ষণে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনার ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
শনিবার (১৪ মার্চ) বিকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে সেমিনার ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল অব বাংলাদেশ (সিএজি) মো. মুসলিম চৌধুরী।
এতে সভাপতিত্ব করেন হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া।
এসময় ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, আমরা অনেক সময় দেখি একজন মানুষ হালদা নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তখন তিনি হাতে থাকা ময়লাগুলো নদীতেই নিক্ষেপ করছে। মনে হয় যেন এ নদীটি সবধরণের বর্জ্যরে ভাগাড়। কিন্তু কেন। আমরা বর্জ্য নদীকে কেন ফেলব। এটি কোনধরণের মানসিকতা।
তিনি আরো বলেন, হালদা নদী কেবল চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশ ঐতিহ্য নয়। এটি উপমহাদেশের ঐতিহ্য। এটি আমাদের গর্বের প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই এটি যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি, তাহলে সেটি আমাদের সকলেরই ব্যর্থতা। কেউ এর দায় এড়াতে পারব না। আর আমরা হালদা পাড়ের বাসিন্দা হিসাবে আমাদের দায় আরো বেশি।
মুসলিম চৌধুরী বলেন, সব ঐতিহ্যের কিছু ডুপ্লিকেট থাকে। কিন্ত হালদা নদী এমন এক ঐতিহ্য যার কোনো ডুপ্লিকেট নেই। হালদা নদীর যে সব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি আছে, তা পৃথিবীর আর কোনো নদীতে নেই। এটি আজ স্বীকৃত একটি বিষয়। কিন্তু এমন ঐতিহ্য যদি আমরা হারিয়ে ফেলি, এটিকে রক্ষা করতে না পারি তাহলে এটি দেশেরই চরম ক্ষতি।
সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি আলী আব্বাস, রাউজান উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. মোয়াজ্জম হোসাইন, চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী, আইডিএফের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রফেসর শহীদুল আমিন চৌধুরী।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া। প্রবন্ধের উপর মুখ্য আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রেনমেন্টাল সায়েন্সেস প্রফেসর ড. মো. মোশাররফ হোসেন।
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) নবনির্বাচিত সভাপতি মোহাম্মদ আলী এবং চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধে হালদা নদী রক্ষায় ২১টি সুপারিশ করা হয়।
উল্লেখ্য, সেমিনারে হালদা নদী রক্ষায় উপস্থাপিত সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ভূজপুর এলাকায় নির্মিত রাবারড্যাম বন্ধ করে কৃষকদের বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করা, উজানের শাখা খালসমুহ খনন এবং স্লুইস গেটসমূহের মৎস্য বান্ধবভাবে আধুনিকায়ন করা, অনন্যা আবাসিক এলাকার ভরাট হয়ে যাওয়া বামনশাহী খাল পুনঃখনন এবং অনন্যার মাস্টার ড্রেনেজ সিস্টেমকে বামনশাহী খাল এবং কুয়াইশ খাল থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, শিকারপুর ও মাদার্শা এলাকার ছোট খাল ও ছড়াসমূহ খনন করার মাধ্যমে পানির প্রবাহ বাধামুক্ত করা, নদীর দুপাশের উপজেলা ও পৌরসভাগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু করা, এশিয়ান পেপার মিল, হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্লান্টসহ অক্সিজেন থেকে কুলগাঁও পর্যন্ত শিল্প-কারখানায় ইটিপি স্থাপনে বাধ্য করা, হাটহাজারীর নন্দীর হাটের স্থানীয় মরাছড়া খালের বর্জ্য ডাম্পিং স্থায়ীভাবে বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠা অবৈধ পোল্ট্রি ফার্মসমূহের দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, উজানের তামাক চাষ বন্ধ করে কৃষকদের বিকল্প চাষের ব্যবস্থা করা, ব্রুড মাছ বৃদ্ধির জন্য নদীর নিজস্ব উৎস থেকে পোনা মাছ বড় করে নিবিড় পরিচর্যা ও পাহারায় নদীতে ছাড়ার ব্যবস্থা করা।
বিশেষ করে রুই এবং কালিবাউস মাছের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ত্রুটিপূর্ণ হ্যাচারিগুলো মেরামতের ব্যবস্থা করা, বিকল্প হ্যাচারি হিসেবে ঐতিহ্যগত মাটির কুয়াগুলোর প্রযুক্তি সংরক্ষণে প্রশিক্ষণ ও আধুনিকায়ন করা, নদী পাহারায় বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী বৃদ্ধি করা, মা মাছের আবাসস্থল বা কুম চিহ্নিত করে পাহারায় সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার ব্যবস্থা করা, হালদা নদী ব্যবস্থাপনায় আলাদা জনবল কাঠামো গঠন করা, রামগড়ের উৎস থেকে কালুরঘাটের কর্ণফুলি নদী পর্যন্ত হালদা নদী ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা, বিপন্ন প্রজাতির ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা।
অন্যদিকে, মানিকছড়ি ও ফটিকছড়ি এলাকায় ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন বন্ধ করা, হালদা নদী ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, জনপ্রতিনিধি, গবেষক, সাংবাদিক, এনজিও ও সুফলভোগীদের সমন্বয়ে ‘হালদা নদী কমিশন’ গঠন করা, হালদা হেরিটেজ সেন্টার স্থাপন করা এবং সর্বোপরি হালদা নদীকে ‘জাতীয় নদী’ ঘোষণার মাধ্যমে এই নদী রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।