নগরে অবৈধ অস্ত্রের উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই পুলিশের কাছে। ছিল না বৈধ অস্ত্রের কোনো পরিসংখ্যানও। আবার অস্ত্রধারীদের ধরতে বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না নগর পুলিশের। অথচ নগরজুড়ে অপরাধে ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি ব্যবহার হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের। এমনকি অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে খোদ পুলিশের বিরুদ্ধেও!
এদিকে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে এবার অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কোমর বেঁধে নেমেছে পুলিশ। প্রথম দফায় নগরের ১৬ থানার বৈধ অস্ত্রধারীদের তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি চলছে অবৈধ অস্ত্রধারীদের তথ্য সংগ্রহের কাজও। এ তথ্যের মাধ্যমে ইতিমধ্যে অবৈধ অস্ত্রধারী কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। উদ্ধার করা হয়েছে বেশ কিছু অবৈধ অস্ত্র। সিএমপি (চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ) কমিশনার মাহবুবুর রহমান নিজেই তত্ত্বাবধান করছেন আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের এ কার্যক্রম।
পাঁচলাইশ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মহিউদ্দিন মাহমুদ জয়নিউজকে বলেন, সিএমপি কমিশনার মহোদয়ের নির্দেশনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নগরজুড়ে শুরু হয়েছে অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে অভিযান। এখন চলছে বৈধ অস্ত্রের তথ্য হালনাগাদ। পাঁচলাইশ এলাকায় ঈদুল আযহার পরদিনও আমরা আগ্নেয়াস্ত্রধারী এক সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছি। এছাড়া পুলিশকে গুলি করার ঘটনায় আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, উদ্ধার করা হয়েছে ব্যবহৃত অস্ত্রও।
চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর) অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সাব্বিরকে। মাত্র ২৪ ঘন্টার মাথায় গোয়েন্দা পুলিশের জালে আটকা পড়ে সাব্বির। বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় মামলা।
শুক্রবার নগরের পাহাড়তলী থানার গ্রীনভিউ আবাসিক এলাকা থেকে মোঃ রাব্বী ও মোঃ রায়হান নামে দুই সন্ত্রাসীকে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। পাহাড়তলী থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ জানান, তাদের কাছ থেকে একটি দেশীয় সিঙ্গেল শুটার গান, দেশীয় এলজি, তিন রাউন্ড গুলি ও দুইটি ধারালো কিরিচ উদ্ধার করা হয়।
সদরঘাট থানা এলাকা থেকে সম্প্রতি দুটি বিদেশি পিস্তল ও একটি দেশি বন্দুক উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রুহুল আমিন জয়নিউজকে জানান, সিএমপি কমিশনারের বিশেষ নির্দেশনায় অস্ত্র উদ্ধারে আমরা বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছি। ইতিমধ্যে আমরা বৈধ অস্ত্রের তথ্যও হালনাগাদ করছি। অচিরেই শুরু হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযান।
বায়েজিদ থানার ওসি আতাউর রহমান খন্দকার জানান, গত দুই মাসে বায়েজিদ থানা এলাকা থেকে ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ অবৈধ অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় আনতে কৌশলী হয়ে কাজ করছে।
কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামরুজ্জামান জয়নিউজকে বলেন, সিএমপি সদর দপ্তরের বিশেষ নির্দেশনায় কোতোয়ালী এলাকায় বৈধ অস্ত্রধারীদের তালিকা হালনাগাদ চলছে। অবৈধ অস্ত্রধারীদের ধরতে আমরা বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।
ডবলমুরিং থানায় সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ধার হয়েছে ৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বেশ কিছু কার্তুজ। এমনকি পুকুর সেচ দিয়েও পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। ডবলমুরিং থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ জহির হোসেন জয়নিউজকে বলেন, ওসি স্যারের নেতৃত্বে ডবলমুরিং এলাকার অবৈধ অস্ত্রধারী আজিজ, রনি, শুক্কুর, জসিম, মনসুরসহ বিভিন্ন জনের কাছে থাকা বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র আমরা উদ্ধার করেছি। গ্রেফতার করা হয়েছে তাদেরকেও। এদের মধ্যে মনসুরের বিরুদ্ধে পনেরটি মামলা রয়েছে বিভিন্ন থানায়। অস্ত্র উদ্ধারে আমাদের অভিযান নিয়মিত চলবে।
চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে ‘টেনশনে’ ছিল পুলিশ। সিআরবি’র জোড়া খুন, এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা, কদমতলীর যুবদল নেতা হারুন হত্যা, বায়েজিদ থানা এলাকায় মেহেদী হাসান বাদল হত্যা, বাকলিয়ায় যুবলীগ নেতা ফরিদ হত্যাকাণ্ডসহ বেশ কিছু ঘটনায় ব্যবহার হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। এসব ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশকে চলতে দেখা গেছে ঢিমেতালে। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নগরের দুই নম্বর গেইট এলাকায় পাঁচলাইশ থানার তল্লাশি চৌকিতে পুলিশকে গুলি করার ঘটনার পর ‘নড়েচড়ে’ বসে পুলিশ। এ ঘটনার পরপরই অবৈধ অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে পুলিশ জোরেশোরে তৎপরতা শুরু করে। এ মামলার প্রধান আসামি খোকন, আইমান ও মাহিকে গ্রেফতার করা হয়। পাঁচলাইশ থানা পুলিশ উদ্ধার করে আগ্নেয়াস্ত্রটিও।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার (সিএমপি) মাহবুবুর রহমান জয়নিউজকে বলেন, বৈধ অস্ত্রধারীদের তালিকা হালনাগাদ চলছে। পাশাপাশি গ্রেফতার করা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রধারীদের। দুঃখের বিষয়, লাইসেন্সকৃত অস্ত্রেরও অপব্যবহার হচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, লাইসেন্সকৃত অস্ত্র অবৈধ কাজে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সব ঘটনায় ব্যবহার হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। অস্ত্রধারী যে-ই হোক আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। যার প্রমাণ সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় পাওয়া গেছে।
নগর পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জয়নিউজকে জানান, নগরীতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার বেড়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে উঠতি বয়সী কিশোরদের হাতেও। কম-বেশী অন্তত পাঁচ হাজার অবৈধ ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র আছে বিভিন্ন স্তরের সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে। তিনি আরো জানান, চট্টগ্রামে মাত্র ২০ হাজার টাকায় বিদেশি পিস্তল পাওয়া যাচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে এসব অস্ত্র দেশে প্রবেশ করছে। বিশেষ করে পয়েন্ট টুটু বোর, সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ এবং পয়েন্ট নাইন এমএম পিস্তল সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। নির্বাচনের আগেই এসব অস্ত্র উদ্ধার করার পরিকল্পনা নিয়েছে পুলিশ।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৬৯টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। এর মধ্যে রয়েছে এলজি ৩১টি, পাইপগান ৫টি, বিদেশী পিস্তল ৮টি, খেলনা পিস্তল ২টি, প্লেয়ারগান ১টি, একনলা বন্দুক ৬টি, দুইনলা বন্দুক ১টি, বন্দুক ৪টি, দেশি বন্দুক ৪টি, কাটা বন্দুক ১টি, ওয়ান শ্যুটারগান ৩টি, শ্যুটারগান ২টি, শর্টগান ১টি। এছাড়া অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে ১৮২টি। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৫৫ জনকে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী জয়নিউজকে বলেন, স্বাধীন দেশে যাদের হাতে অবৈধ অস্ত্র থাকে তাদের অন্য কোন পরিচয় নেই, তাদের একটাই পরিচয় তারা সন্ত্রাসী। আইনের কঠোর প্রয়োগই তাদের দমনের একমাত্র পন্থা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিসহ বিভিন্ন অপশক্তি অস্ত্র, বোমাবাজিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। যা আমরা অতীতে দেখেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানই পারে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের প্রবণতা ঠেকাতে।
তিনি আরও বলেন, অতীতে বিভিন্ন সরকার দলীয় নিয়োগ দিয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি পেয়েছে। তাদের ওপর নজরদারি রাখা উচিত। এছাড়া অস্ত্রধারী ও নাশকতার মামলার আসামিদের জামিন দেওয়ার একটি প্রবণতা অতীতে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের আগে দেখা গেছে। সন্ত্রাসীরা বের হতে পারলে অস্ত্রের ব্যবহার বাড়বে। তাই আইনের ফাঁকফোকর গলে যেন এ ধরনের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন না পায় সে বিষয়ে রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তাদের সচেতন হওয়া উচিত।
জয়নিউজ/হোসেন