দিনটি ছিল শুক্রবার। অমাবস্যা তিথির জো’র প্রথম দিন। আকাশে ছিল না মেঘের গর্জন। তবে কয়েকদিনে দুয়েক পশলা বৃষ্টি হলেও ছিল না ভারি বর্ষণ। পুরানো ঐতিহ্যকে পেছনে ফেলে সামান্য বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢলের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে নদীতে তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে অবশেষে রুই জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছ ডিম ছাড়ে।
শুক্রবার (২২ মে) হালদার ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবীরা ১৪ বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ ডিম আহরণ করেছে। মৎস্য অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) হালদা রিসার্চ ল্যাব ও উন্নয়ন সংস্থা আইডিএফের তিনটি টিম এবার মা-মাছের ডিম সংগ্রহের কর্মযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের সম্মিলিত হিসাবে ২৮০টি নৌকায় ৬১৫ জন ডিম সংগ্রহকারী এবার মাছের ডিম সংগ্রহ করেছেন। সব মিলে তারা এবার ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি মাছের ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন। যা বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে রেকর্ড পরিমাণ ডিম আহরণের পর হালদার দু’পাড়ের ঘরে ঘরে চলছে ‘ঈদ আনন্দ’। হালদা পূরনো রূপে ফিরে যাওয়া খুশি ডিম আহরণকারী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণেই হালদা হারানো যৌবন ফিরে পাচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
হালদার ডিম সংগ্রহকারী গড়দুয়ারা এলাকার মৎস্যজীবী কামাল সওদাগর জয়নিউজকে বলেন, অনেক বছর পর হালদা পুরনো রূপে ফিরেছে। এবার প্রচুর ডিম সংগ্রহ করেছি। তাঁর ছয়টি নৌকায় তিনি প্রায় ৪৫ বালতি নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেছেন। যা বিগত এক যুগেরও আগে এভাবে ডিম করেছিল। এবারের মা-মাছের দেওয়া নিষিক্ত ডিমগুলো বেশ পরিপুষ্ট।
এদিকে হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, ২০১৯ সালে ৭ হাজার কেজি, ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি, ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ২০০ কেজি, ২০১২ সালে ২১ হাজার ২৪০ কেজি, ২০১১ সালে ১২ হাজার ৬০০ কেজি, ২০১০ সালে ৯ হাজার কেজি, ২০০৯ সালে ১৩ হাজার ২০০ কেজি, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৪০০ কেজি, ২০০৭ ২২ হাজার ৩১৪ কেজি এবং ২০০৬ সালে ৩২ হাজার ৭২৪ কেজি ডিম পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হালদা গবেষক ড. মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জয়নিউজকে বলেন, নানামুখী পদক্ষেপের কারণে হালদা ধীরে ধীরে পূরণে রূপে ফিরে যাচ্ছে। গত ৪-৫ বছর ধরে হালদায় ডিম আহরণের পরিমাণ বাড়ছে। এ বছর তো নিকট অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তিনি আরও বলেন, হালদায় দূষণ সৃষ্টি করা দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায়, লকডাউনের কারণে নদী তীরের শিল্প প্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ থাকায়, বালুবাহী ড্রেজার চলাচল বন্ধ থাকায় এবং মা মাছ নিধন বন্ধে অভিযান জোরদার হওয়ায় এবার বেশি ডিমের প্রত্যাশা ছিল সংশ্লিষ্টদের।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন জয়নিউজকে বলেন, হালদাকে আগের রূপে ফেরাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানান পদপক্ষে নেওয়া হয়। গত এক বছরে হালদার মা মাছ রক্ষা করতে ১০৯টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে ড্রেজার, ঘেরা জাল, বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহার করা পাইপ ও নৌকা। সবার সম্বিলিত প্রচেষ্টায় হালদা পুরনো রূপ ফিরে পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীদের মধ্যে এখন বিরাজ করছে ঈদের আনন্দ। তারা ডিম সংগ্রহের পর থেকে রেণু ফোটানোর কর্মযজ্ঞতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। যা দেখে সত্যিই আমি অভিভূত।
এদিকে ডিম ছাড়ার পর মা-মাছগুলো খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় যাতে কেউ মাছ শিকার ও কৃত্রিম রেনু বিক্রেতারা যাতে সক্রিয় হতে না পারে সে লক্ষ্যে প্রশাসন কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করেছে বলেও ইউএনও জানান।