মোহাম্মদ নাসিমের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে কি দুর্বিষহ জীবন পার করে রাজনীতি করেছেন তিনি। রাজনীতির মধ্যেই যেন বাবাকে খুঁজে পেয়েছেন সদ্য প্রয়াত এই নেতা। জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এম মনসুর আলীর পুত্র সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতা মোহাম্মদ নাসিম তার বাবার স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, ‘শেষবারের মতো বাবার লাশও দেখতে পারিনি, আমার সৌভাগ্য- বাবা এম মনসুর আলীসহ পাবনার অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে আমরা পিতা-পুত্র একসঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম।’
তখন ১৯৬৬ সাল। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে এইচএসসির ছাত্র ছিলেন। ভুট্টা খাওয়ার বিরোধিতা করে ওই অঞ্চলের জনগণ তীব্র আন্দোলনে নেমেছিল। সেই আন্দোলনে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে নাসিমকে নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বাবা এম মনসুর আলীসহ পাবনার অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে নাসিমও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পিতা-পুত্রও জেলে গেলেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, জেলজীবনে কখনও মনে হয়নি, জেলখানায় ছিলাম। কারণ বাবা এম মনসুর আলী আমাকে সর্বদা আগলে রাখতেন। এছাড়া বয়সে ছোট হওয়ার কারণে সবাই আদর-স্নেহ করতেন। জেলে বসেই এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
এক বছর জেলখানায় থাকার পর নাসিমকে মুক্তি দেওয়া হলো। কিন্তু বাবা ও তার সহকর্মীরা কেউ মুক্তি পেলেন না। জেল থেকে মুক্ত হয়ে আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে অঝোড়ে কেঁদেছিলেন নাসিম। কারণ বাবাকে জেলখানায় রেখে নিজে মুক্ত হয়ে বাইরে আসা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। এর প্রায় দুই বছর পর বাবা জেলখানা থেকে মুক্তি পেলেন। তাকে বরণ করার জন্য অন্যান্য নেতাকর্মীর সঙ্গে গেলেন নাসিমও। নাসিম বলেছেন, ‘বাবার সঙ্গে জেলখানার সেই স্মৃতি আজও আমার হৃদয়ে অমলীন।’
এরপর বাবার রাজনৈতিক জীবনে তার ছেলে হিসেবে কিছু বিষয় প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশনা মেনেই মুজিবনগর সরকার গঠন করেছিলেন শহীদ এম মনসুর আলীসহ জাতীয় চার নেতা। দুঃসাহসিক ও গৌরবময় সেই দিনগুলোতে পিতা এম মনসুর আলী কী দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনতে এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কাজ করে গেছেন, তা তিনি সঙ্গে থেকেই দেখেছেন।
খন্দকার মোশতাকের মতো কয়েকজন সুযোগসন্ধানী মুজিবনগর সরকারের এই চার নেতার মধ্যে ফাটল ধরানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। বেঈমান মোশতাক স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করার নানা প্রলোভনের জাল বিস্তার করে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বকে বারবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু একটি বিপদাপন্ন জাতির শহীদ এম মনসুর আলী অন্য তিন নেতার সঙ্গে থেকে সব ভয়ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং প্রলোভন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করেছেন। সহকর্মীদের উদ্দেশে তিনি সর্বদা বলতেন- বাঙালির বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা ইনশাল্লাহ মুক্ত করব।
শহীদ এম মনসুর আলী তখন প্রধানমন্ত্রী। সরকারি বাসভবনে সপরিবারে বসবাস করতেন মোহাম্মদ নাসিমরা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার দুঃসংবাদটি যখন শহীদ এম মনসুর আলী পেয়েছিলেন, তখন তিনি কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। নাসিম বলেছেন, ‘আমরা মা, ভাইবোন সবাই ভেঙে পড়েছিলাম। বাকরুদ্ধ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হতেই দেখলাম, তিনি শিশুর মতো অঝোরে কাঁদছেন।’
তৎকালীন সেনাপ্রধান কেএম সফিউল্লাহসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টেলিফোনে প্রতিরোধের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কাপুরুষের দল কেউ এগিয়ে আসেনি। অসহায় মনসুর আলী সহকর্মীদের পরামর্শে আত্মগোপনে চলে গেলেন। কিন্তু আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ও – কী উদ্বেগ, প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর কথা মনে করছেন; অন্যদিকে প্রতিশোধ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে দলীয় সহকর্মী, তদানীন্তন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু কিছু সহকর্মীর ভীরুতা, আপসকামিতা এবং জীবন রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা; অন্যদিকে সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের কাপুরুষতার কারণে মনসুর আলী ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই শহীদ এম মনসুর আলী পালানোর নির্দেশ দিলেন নাসিমকে’।
সেই স্মৃতি নাসিম বলেছেন, ‘মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির এক আত্মীয়ের বাসায় ১৬ আগস্ট গভীর রাতে তিনি আমাকে বিদায় জানালেন। বিদায় বেলায় তিনি বলেছিলেন- দুঃখী, মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তিনি যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তা থেকে যেন কখনও বিচ্যুত না হই। বাবার সেই উপদেশ আজও মেনে চলি। বিদায় বেলায় তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছেন।
বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় আমিও বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলাম। সেদিন দেশ ছাড়ার মুহূর্তটি পাথরচাপা কষ্টের মতো আজও বয়ে চলেছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, যেন আমার বাবাকে সুস্থ রাখেন, ভালো রাখেন। কিন্তু পরদিনই অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে তিনি গ্রেফতার হলেন। পরে ৩ নভেম্বর ভোরে জেলখানায় নির্মমভাবে বাবাসহ চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হলো।’
তিনি জানান, ‘আমার জীবনের ভয়ংকর সেই দুঃসংবাদটি আমি শুনতে পেলাম ৪ নভেম্বর। আমি তখন বিদেশে আত্মগোপনে ছিলাম। বাবাকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ থেকেও আমি বঞ্চিত হয়েছিলাম।