অফিসিয়াল গাড়ি ব্যবহার না করে বিলাসবহুল পাজেরো ব্যবহার করতেন বোয়ালখালী থানার ওসি সাইরুল ইসলাম। থানা এলাকায় ঘুরতেন এ গাড়ি নিয়ে। থানার রেস্টরুমের এসি খুলে নিজ কক্ষে লাগিয়েছেন তিনি। বিলাসবহুল গাড়িতে থানার ওসির ঘোরাঘুরি আর রেস্টরুমের এসি নিজ কক্ষে সাঁটানো দেখে শুরু হয় সমালোচনা।
ওসির এই ‘অদ্ভুত’ কাণ্ডে পুলিশ বাহিনীর প্রতি এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেয়। এ নিয়ে সংবাদ প্রচার করে একুশেপত্রিকাডটকম। তাই এই পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে নিজ থানায় ওসি দায়ের করেন সাধারণ ডায়েরি! অবাক করার বিষয় হল, ডায়েরিতে তিনি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার ও রেস্টরুমের এসি নিজ কক্ষে লাগানোর কথা স্বীকার করেছেন।
গোপনীয়তা রক্ষা করে এ সাধারণ ডায়েরি দায়ের করা হলেও গণমাধ্যম কর্মীদের এ তথ্য জানতে সময় লেগেছে পাঁচদিন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এ সাধারণ ডায়েরি দায়ের করা হয়। জিডির নম্বর ৮৪৩।
এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর ‘সরকারি গাড়ি নয়, কর্মস্থলে ব্যক্তিগত গাড়িতে ঘোরেন ওসি!’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে একুশে পত্রিকা। এতে উল্লেখ করা হয়, বোয়ালখালী থানার নতুন ওসি সাইরুল ইসলাম সরকারি গাড়ির পরিবর্তে ব্যক্তিগত বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করছেন। এছাড়া বোয়ালখালীতে যোগদানের আগে ওসির কক্ষে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (এসি) লাগান সাইরুল ইসলাম।
এ সংবাদ প্রকাশের খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওসি নিজ থানায় একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদারের বিরুদ্ধে এ সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেন। জিডিতে বিলাসবহুল প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে ঘোরার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। ওসি উল্লেখ করেন, ‘… সংবাদের বিষয়ে এই মর্মে ভবিষ্যতের জন্য নোট করিতেছি যে, আমার গাড়ি হিসেবে যে গাড়িটি ব্যবহার করিতেছি মর্মে সংবাদ প্রকাশ করা হইয়াছে, তাহা আমার ছোটভাই সাইফুল ইসলামের ব্যবহৃত নিজস্ব গাড়ি। যাহা কয়েকদিন আগে আমার ছোটভাই ঢাকা হইতে চট্টগ্রামে নিয়ে আসার পর গাড়িটিতে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় গাড়িটি মেরামতের জন্য আমার কাছে রেখে যায়।’
নিজের কক্ষে এসি লাগানোর বিষয়টি স্বীকার করে ডায়েরিতে উল্লেখ করেন, ‘পূর্ব থেকে থানার রেস্ট রুমে থাকা এসিটি স্থান বদল করে আমার অফিসকক্ষে লাগানো হইয়াছে। এই ক্ষেত্রে কাহারো থেকে কোনোপ্রকার দান বা অনুদান গ্রহণ করা হয় নাই।’
এতে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘…রেজি:বিহীন বেআইনিভাবে একুশে পত্রিকা নামীয় অনলাইন সংবাদপত্রের সম্পাদক সঠিকতা ও বাস্তবতা যাচাই না করিয়া মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য সম্বলিত সংবাদটি প্রকাশ করিয়াছে। …উক্ত বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি গোচরিভূতকরণসহ সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে ভবিষ্যতের জন্য ডায়রিতে নোট রাখা হইল।’
এ বিষয়ে বোয়ালখালী থানার ওসি সাইরুল ইসলামের অফিসিয়াল মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে প্রথম দফায় তিনি রিসিভ করেননি। কিছুক্ষণ পর কল করা হলে ওসির মোবাইল থেকে কথা বলেন এসআই তাজ উদ্দিন। তিনি একুশেপত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদারের বিরুদ্ধে ওসি সাইরুল ইসলাম সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেছেন বলে নিশ্চিত করেন।
একুশেপত্রিকা’র সম্পাদক আজাদ তালুকদার জয়নিউজকে বলেন, সমাজের অসঙ্গতি, সম্ভাবনা তুলে ধরে গণমাধ্যম। বোয়ালখালী থানার ওসির বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার ও রেস্টরুমের এসি খুলে নিজের রুমে লাগানোর বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এর সত্যতা ওসি নিজেই তার সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন। এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না। সরকারের অনুমোদন নিয়ে বিগত ১৪ বছর ধরে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে ‘একুশেপত্রিকা’ ছাপা হচ্ছে।
সাধারণ ডায়েরিতে একুশেপত্রিকাকে রেজিস্ট্রেশনবিহীন উল্লেখ করার প্রসঙ্গে আজাদ তালুকদার বলেন, একুশেপত্রিকা পাঠক চাহিদার কথা বিবেচনা করে গত তিনবছর ধরে অন্য গণমাধ্যমগুলোর মত অনলাইন ভার্সন চালু করে। এর বাইরে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অনলাইন পত্রিকা হিসেবে নিবন্ধন পেতে আবেদন করে ‘একুশেপত্রিকাডটকম’। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো অনলাইন গণমাধ্যমকে সরকার নিবন্ধিত করতে পারেনি; তবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার পর অনলাইন পত্রিকা হিসেবে সক্রিয় থাকার ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা নেই বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে বিভিন্ন সময়ে জানানো হয়েছে।
সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরির বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ জয়নিউজকে বলেন, সংবাদ প্রকাশের জের ধরে সাধারণ ডায়েরি করা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার শামিল। বর্তমান সরকারের আমলে গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত ও বিকশিত হলেও, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার কারণে দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠছে।
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নাজিম উদ্দিন শ্যামল বলেন, পুলিশের প্রতি জনগণের যেটুকু আস্থা রয়েছে সে আস্থাটুকু নষ্ট করতে এমন আচরণই যথেষ্ট। আমরা এ ধরনের হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।
সাংবাদিক আজাদ তালুকদারের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করায় নিন্দা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সভাপতি কলিম সরওয়ার, সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নাজিমুদ্দিন শ্যামল, সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, নির্বাহী সদস্য রুবেল খান ও আজহার মাহমুদ।
জয়নিউজ/অভি/আরসি