সম্প্রতি আফ্রিকাসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’। বাংলাদেশে এই ধরনের প্রবেশ ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। ধরনটি প্রতিরোধে আকাশ পথের পাশাপাশি দেশের সব সীমান্তে কড়াকড়ি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
শনিবার (২৭ নভেম্বর) সকালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিতব্য ‘World Health Assembly Second Special Session’ এ অংশ নিতে যাত্রাকালে এক অডিও বার্তায় এসব কথা জানান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। নতুন এই ধরন করোনার অন্যান্য ধরনগুলোর তুলনায় কিছুটা বেশি মারাত্মক বলে জানিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) সম্পর্কে আমরা অবহিত হয়েছি। এটি খুবই এগ্রেসিভ (মারাত্মক)। সে কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থগিত করা হচ্ছে। এবং সকল বিমানবন্দর, স্থলবন্দরে স্ক্রিনিং (শনাক্তকরণ) প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্টদের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক পড়ার বিষয়েও তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলা পর্যায়েও নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য জায়গা থেকেও যারা আসবে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের টিকা নেওয়া ও আরটি-পিসিআর টেস্টের (পরীক্ষা) বিষয়টি দেখতে হবে।’
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় হঠাৎ করেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে করোনা। যার পেছনে করোনার নতুন ধরনকে দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালানো ডেল্টার চেয়েও এটি মারাত্মক হতে পারে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি কড়াকড়ি ব্যবস্থা নিয়েছে সিঙ্গাপুর ও ভারতের মতো এশিয়ার দেশগুলোও।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশেও করোনার নতুন এই রূপ ঠেকাতে সীমান্তে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদারের ঘোষণা আসল সরকারের পক্ষ থেকে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও এখনো ভয় কাটছে না। সব সময় সতর্ক থাকা উচিত। ডেল্টা তো আছেই, যেকোনো সময়ে নতুন ধরনের উদ্ভব হতে পারে।
ড. মোশতাক হোসেন বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ এখনো ক্রমবর্ধমান। দক্ষিণ আফ্রিকার এই ধরন আমরাও পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের জিনোম সিকোয়েন্স সক্ষমতা কম। এটি বাড়ানো দরকার। বর্তমানে যত জন আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের সবারই করতে পারলে ভালো হতো। তাহলে পরিবর্তিত ধরন এখানে আসলে দ্রুত শনাক্ত করার পাশাপাশি ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হতো।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, প্রাথমিকভাবে বি.১. ১.৫২৯ নামে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকান নতুন এই ধরনের গ্রিক নাম ওমিক্রন। যা বারবার মিউটেট (আচরণ পরিবর্তন) হচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তত ৩২ বার রূপ বদলেছে। এতে করে করোনাভাইরাস নতুন করে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
গত বুধবার দক্ষিণ আফ্রিকা এই ধরন শনাক্তের খবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএইচও) জানায়। পরে বতসোয়ানা, বেলজিয়াম, হংকং ও ইসরায়েলে এই ধরন পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা, হংকং ও বতসোয়ানায় ৫৯ জন ব্যক্তি নতুন এই ধরনের শিকার হয়েছেন।
নতুন এই ধরন বিশ্লেষণ করে ডব্লিউএইচওর বিবৃতিতে বলা হয়, ওমিক্রন ধরনের ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে মিউটেশন হয়েছে। এখন পর্যন্ত যা বোঝা যাচ্ছে তাতে সংক্রমণের মাত্রা আবারও মহামারির দিকে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ওমিক্রনের সংক্রমণের ক্ষমতা, শারীরিক জটিলতা, চিকিৎসা ও টিকার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ আফ্রিকার ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বা সীমাবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউকে, আইরিশ বা যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা নয় এমন কেউ দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, লেসোথো এবং এসওয়াতিনি থেকে ভ্রমণকারীরা যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না। এসব দেশের সঙ্গে সোমবার থেকে বিমান যোগাযোগ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ এবং সুইজারল্যান্ডও সাময়িকভাবে ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে চলতি মাসে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা শিথিলের পর নতুন ধরন শনাক্তের খবরে উৎকণ্ঠায় পড়েছে ভারত। সব রাজ্যকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও এবং ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য দেশগুলো থেকে আসা ব্যক্তিদের করোনা পরীক্ষা কঠোরভাবে করার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। এমতাবস্থায় বাংলাদেশেও ভাইরাসটির প্রবেশ ঠেকানো ও এর ভয়াবহতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এখনই আমাদের সতর্ক হতে হবে। প্রয়োজনে সতর্কতা জারি করতে হবে। নতুন এ ধরনের শনাক্ত হওয়া খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডেল্টার চেয়েও যদি এটি মারাত্মক হয় এবং দেশে আসে, তাহলে ফের পরিস্থিতি খারাপ হবে।
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, নতুন ধরন ঠেকাতে সরকার কয়েকটি বিষয়ের প্রতি জোর দিতে পারে। প্রথমত, আপত্কালীন একটি পরিকল্পনা ও কমিটি করা। পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ ও কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা পরামর্শ দেবেন তাঁরা। দ্বিতীয়ত, টিকায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১৮ বছরের বেশি ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। আর যে দেশে এই ধরন সংক্রমণ ছড়াবে সেখান থেকে কাউকে আসতে না দেওয়া।