চট্টগ্রাম কাস্টমসের বাজিমাত

গত ২৪ বছরে নির্বাচনি বছরগুলোতে রাজস্ব আয়ের ধারা ছিল নিম্নমুখী। সহিংসতা-ধর্মঘট, হরতাল-নাশকতার নেতিবাচক প্রভাব ছিল রাজস্ব আয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ফলে এ আয়ে মিলেছে ইতিবাচক সাড়া। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে যে রাজস্ব আয় হয়েছে, তা ছাড়িয়েছে অতীতের নির্বাচনি বছরগুলোর রেকর্ড।

- Advertisement -

শুধু চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে রাজস্ব আয় হয়েছে ১০ হাজার ৪৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যা বিগত চারটি পৃথক নির্বাচনি বছরের প্রবৃদ্ধি অর্জনকে ছাড়িয়ে গেছে। গত দু’যুগে পাঁচ নির্বাচনি বছরের রেকর্ড পর্যালোচনা করে মিলেছে এ তথ্য।

- Advertisement -google news follower

কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন আসার আগে টানা হরতাল-অবরোধ ছিল দেশের নিত্য চিত্র। আন্দোলনের নামে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ছড়িয়ে পড়ত আতঙ্ক। এ পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সড়ক-পরিবহন খাত। যে খাতের উপর নির্ভর করে দেশের আমদানি-রফতানি। আমদানি-রফতানির উপর নির্ভর করে দেশের রাজস্ব আহরণ।

নির্বাচনের আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশজুড়ে ছিল রাজনৈতিক সহিংসতা। যার ফলে এই নির্বাচনি অর্থবছরে ২৩ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে। প্রবৃদ্ধির হিসাবে বিগত নির্বাচনি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জন ছিল নেতিবাচক। অঙ্কের হিসাবে যা (-) ০ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

- Advertisement -islamibank

বিপরীতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর নির্বাচনি বছর হলেও এ বছরের রাজনৈতিক আমেজ ভিন্ন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকায় চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই আয় হয়েছে ১০ হাজার ৪৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে যে সংখ্যা ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ।

এর আগে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৭ শতাংশ। অর্থের অঙ্কে যার পরিমাণ ১৪ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। ২০০১-০২ নির্বাচনি অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয় ৭ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ৪ শতাংশ। ১৯৯৫-৯৬ নির্বাচনি অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয় ৪ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ড. এ কে এম নুরুজ্জামান জয়নিউজকে বলেন, বিগত নির্বাচনি বছরগুলোর তুলনায় এই নির্বাচনি অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। গত নির্বাচনি বছরের তুলনায় আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ শতাংশ।

তিনি বলেন, অতীতের রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, নির্বাচনি বছর এলে নানা অনিশ্চয়তায় আমদানি কমিয়ে দিতেন ব্যবসায়ীরা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ত রাজস্ব আয়ে। কিন্তু চলতি বছর দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। যার ফলে রাজস্ব আয়ও বেড়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক নিতাই চন্দ্র নাগ জয়নিউজকে বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূল ধারণা। এর ফলে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লেই বাড়ে প্রবৃদ্ধি। বিগত নির্বাচনি বছরগুলোতে আমাদের দেশে প্রবৃদ্ধির হার কম ছিল। কারণ নির্বাচনের আগেই দেশজুড়ে হরতালসহ নানা ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি পালন করে কিছু রাজনৈতিক দল। যার প্রমাণ ২০১৪ সালের আগুনসন্ত্রাস। দেশজুড়ে ছিল অস্থিতিশীল পরিবেশ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে।

তিনি বলেন, বর্তমানে নির্বাচন এগিয়ে এলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিবেশ সুন্দর রয়েছে। যার ফলে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, এ বছর ব্যবসায়ের গতিশীলতা ভালো। কোনো হরতাল-অবরোধ ছিল না। ২৪ ঘণ্টা কাস্টমস ও বন্দর খোলা ছিল। যে কারণে ব্যবসায়ীরা নির্ভয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। সরকার ব্যবসায়ীদের নানা প্রণোদনা দিয়েছে। ফলে আমদানি-রফতানি বেড়ে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধিও বৃদ্ধি পেয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, ১৯৯৫-৯৬ সালের নির্বাচনি অর্থবছরে রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আহরণ হয় ৪ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আহরণ হয় ৫ হাজার ২০১ কোটি টাকা। ওইবছর প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অর্জিত রাজস্ব ৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ১৩ দশমিক ৯২ শতাংশ।

১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে অর্জন হয় ৬ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ।

১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। অর্জিত রাজস্ব ৬ হাজার ৮২ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় (-) ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।

২০০০-০১ সালে নির্বাচনি বছরের আগের অর্থবছরে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। সরকার রাজস্ব অর্জন করে ৭ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। এ বছর প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ২০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

২০০১-০২ সালে নির্বাচনি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। অর্জন হয় ৭ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় ৪ শতাংশে।

নির্বাচনের পরের বছর অর্থাৎ ২০০২-০৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। রাজস্ব অর্জন হয় ৮ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশের ঘরে।

২০০৩-০৪ অর্থবছরে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা এবং অর্জন হয় ৯ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ।

২০০৪-০৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব অর্জিত হয় ১০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

২০০৫-০৬ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ১১ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার বিপরীতে অর্জন হয় ১০ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি কমে হয় (-) ১.৫০ শতাংশ।

২০০৬-০৭ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। অর্জিত হয় ১০ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা রাজস্ব। প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় কমে আসে (-) ০.২২ শতাংশে।

২০০৭-০৮ অর্থবছরে রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বিপরীতে অর্জিত হয় ১৩ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ৩০ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

২০০৮-০৯ নির্বাচনি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার ৭১ কোটি টাকা। রাজস্ব অর্জিত হয় ১৪ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। কিন্তু প্রবৃদ্ধি ৩০ দশমিক ৪৬ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ৭ শতাংশে।

নির্বাচনের পরের অর্থবছর ২০০৯-১০ সালে রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয় ১৬ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। ৭ শতাংশ থেকে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশে।

২০১০-১১ অর্থবছরে ১৯ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ছিল রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা। অর্জিত হয় ২০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। একইসঙ্গে প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২১ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।

২০১১-১২ সালের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা এবং অর্জিত হয় ২৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ১২ শতাংশ।

২০১২-১৩ সালে রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। অর্জিত হয় ২৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। তবে প্রবৃদ্ধি কমে নেমে আসে ২ শতাংশে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস আরো জানায়, নির্বাচনি বছর ২০১৩-১৪ সালে রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। অর্জিত হয় ২৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। নির্বাচনি বছরে প্রবৃদ্ধি কমে (-) ০ দশমিক ৪৮ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।

নির্বাচনের পরের বছর ২০১৪-১৫ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। বিপরীতে ২৩ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা অর্জিত হয়। নির্বাচনি বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়ে (-) ০.৪৮ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অর্জন হয় ৩১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন ১৫ শতাংশ।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। অর্জিত রাজস্ব ৩৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। এ বছর প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় ১৬ শতাংশ।

গত অর্থবছর ২০১৭-১৮ সালে রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৪৪ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা এবং অর্জিত রাজস্ব ৪২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ১৬ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তিন মাসে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৯৩৫ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা। বিপরীতে এ তিন মাসে রাজস্ব অর্জিত হয়েছে ১০ হাজার ৪৪৩ দশমিক ৭০ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসে প্রবৃদ্ধি অর্জন ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ। যা বিগত চার নির্বাচনি অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।

<h5/>জয়নিউজ/আরসি<h5/>

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM