ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা বা ২৫ শতাংশ। বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৩৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টিরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
এই সময়ে অপরিবর্তিত ছিল ৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি। আশার দিক হচ্ছে, মার্চ প্রান্তিকে ৬টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
তথ্য মতে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য টানা তিন বছর ডেফারেল সুবিধা ছিল। ডেফারেল বা বিশেষ সুবিধা নিয়ে অনেকে খেলাপি থেকে মুক্ত ছিল। এ সুবিধা তুলে নেওয়ার কারণে আবার তারা খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে পুরো খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
এছাড়া গত ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিয়েছিল, তা নিরীক্ষিত ছিল না। তাই পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ খেলাপি করে দেওয়া হয়। এ কারণেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে বলে খাতসংশ্লিষ্টরা জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট ঋণস্থিতি ছিল ৭১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। গত ৩১ ডিসেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণস্থিতি ৭০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। এর মানে শেষ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে ৮২৯ কোটি টাকা। এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। মার্চ শেষে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ শেষে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬২২ কোটি টাকা।
দেশের ৩৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ মার্চ প্রান্তিকে বেড়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফনিক্স ফাইন্যান্সের। তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি বেড়েছে ৩৬০ কোটি টাকা। এরপরই অবস্থান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।
প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি বেড়েছে ১৫৫ কোটি টাকা। খেলাপি বৃদ্ধির দিকে থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্সের বেড়েছে ১০৪ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডকলের বেড়েছে ৯৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা, বে লিজিংয়ের ৯৩ কোটি, বিআইএফএফএল-এর ৭০ কোটি ৬৩ লাখ, লংকাবাংলার ৬৭ কোটি, বিডি ফাইন্যান্সের ৫২ কোটি ৩২ লাখ, আইএফডিসি ফাইন্যান্সের ৪২ কোটি ৭৮ লাখ এবং ফাস্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
খেলাপি বৃদ্ধির তালিকায় থাকা মাইডাস ফাইন্যান্সের ৩০ কোটি ২২ লাখ, আইআইডিএফসি’র ২৯ কোটি ২৪ লাখ, পিপলস লিজিংয়ের ২৫ কোটি ২২ লাখ, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সের ২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা খেলাপি বেড়েছে।
এছাড়া তালিকায় আরও আছে অগ্রণী এসএমই, আভিভা ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, সিবিসি ফাইন্যান্স, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং, জিএসপি ফাইন্যান্স, ইসলামিক ফাইন্যান্স, লংকান অ্যালায়েন্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্স।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, আলোচিত সময়ে ৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি কমেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে এফএএস ফাইন্যান্সের। প্রতিষ্ঠানটির তিন মাসে খেলাপি কমেছে ৯১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
খেলাপি কমার দিকে থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা উত্তরা ফাইন্যান্সের খেলাপি কমেছে ৮৯ কোটি টাকা। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রিমিয়ার লিজিংয়ের খেলাপি কমেছে ৪৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
এছাড়া হজ্জ ফাইন্যান্সের ১৮ কোটি ৫১ লাখ, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৪ কোটি ৩২ লাখ এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটালের খেলাপি কমেছে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
আর আলোচিত সময়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি অপরিবর্তিত আছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, সাউদি বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড এগ্রিকালচার ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি, স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স এবং দি ইউএসএ বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য টানা তিন বছর ডেফারেল সুবিধা ছিল। ডেফারেল সুবিধা নিয়ে অনেকে খেলাপি থেকে মুক্ত ছিল। এ সুবিধা তুলে নেওয়ার কারণে আবার তারা খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে মার্চ প্রান্তিকে পুরো খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ থাকার কারণে অনেকে ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি। এটাও খেলাপি ঋণ বাড়ার একটা কারণ। ঋণ দেওয়ার সময় যাচাই-বাছাই না করার কারণে এ খাতে খেলাপি ঋণের হার বেশি। এছাড়া ব্যাংকের অনেক মেকানিজম রয়েছে, যেটা আমাদের নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৩০ থেকে ৯৯ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ শেষে সবচেয়ে বেশি খেলাপি পিপলস লিজিংয়ের। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ৯৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। এরপরই বিআইএফসি, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ৯৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। তৃতীয় ফারইস্ট ফাইন্যান্স। এ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৯০ দশমিক ৯৩ শতাংশ, ফাস্ট ফাইন্যান্সের ৮৯ দশমিক ৯০ শতাংশ, এফএএস ফাইন্যান্সের ৮৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ৫৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, আইআইডিএফসির ৫০ দশমিক ২০ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৪৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের খেলাপি ৪৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্সের ৪২ দশমিক ৭০ শতাংশ, বে লিজিংয়ের ৪১ দশমিক ২৪ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ৩৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ফনিক্স ফাইন্যান্স ৩৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ৩৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের হার ৩০ দশমিক ০২ শতাংশ।
এছাড়া ১০ থেকে ২০ শতাংশ আছে ৭টিতে। তবে ৯টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠানের ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশ ঋণই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিকভাবে ৩ শতাংশ খেলাপি ঋণ সহনীয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সে হিসাবে মাত্র ৪টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ১ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।
জানা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত বেশ আগে থেকেই খারাপ অবস্থায় পড়েছে। তবে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর মধ্যে প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) একসময়কার নিয়ন্ত্রণে থাকা আরও তিন প্রতিষ্ঠান তথা বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের নানা জালিয়াতির বিষয় সামনে আসে। তহবিল সংকট চলছে এসব প্রতিষ্ঠানে। দেশরূপান্তর