কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে বৌচি-গোল্লাছুটের মতো জনপ্রিয় সব গ্রামীণ খেলা। পহেলা বৈশাখ কিংবা অন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিছু কিছু গ্রামীণ খেলার দেখা মিললেও বাকি সময় আর দেখা যায় না। গ্রামীণ খেলার পরিবর্তে শিশু-কিশোরদের হাতে স্থান করে নিয়েছে স্মার্টফোন। স্মার্টফোনে গেমস ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সময় কাটছে তাদের। খেলাধুলার অভাব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। যুবসমাজ ঝুঁকছে মাদকের দিকে।
বর্তমানে গ্রামে মাঠের অভাব না থাকলেও খেলাধুলার আয়োজন করার মতো লোকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শহরে মাঠের অভাবে শিশু-কিশোররা খেলার সুযোগ পাচ্ছে না। গ্রামের শিশুরাও খেলাধুলা বলতে এখন ফুটবল-ক্রিকেটকে বোঝে। বিভিন্ন এলাকার গ্রামাঞ্চলে একসময় প্রায় শতাধিক গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচলন ছিল। তার মধ্যে ছেলেরা খেলতো ডাংগুলি, কাবাডি, গোল্লাছুট, খেটে খেলা, দৌড়-ঝাঁপ, গাদন, চিকে, কপালটোকা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, মালাম খেলা, কুস্তি, ডুবসাঁতার, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, হৈল বৈল, বস্তাদৌড়, লুকোচুরিসহ অনেক খেলা। আর মেয়েরা খেলতো দাঁড়িয়াবাঁধা, গোল্লাছুট, এক্কাদোক্কা, পাঁচগুটি, চোরপুলিশ, বৌচি, কড়ি খেলা, বালিশ বদল, লুকোচুরি, পুতুল খেলা, রান্নাবাটিসহ বিভিন্ন খেলা। এ সব খেলাগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির পথে। তার মধ্যে এখনও কিছু স্থানে কাবাডি, লাঠিখেলাসহ হাতেগোনা কয়েকটি খেলার প্রচলন আছে। এখনও গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ, মহররম ও গ্রামীণ মেলার সময় এসব খেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার পরিবর্তে অনেকদিন আগেই এদেশে প্রচলন হয় ফুটবল খেলার। বর্তমানে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে এ খেলাটিও বিপন্ন অবস্থায়। সে তুলনায় ক্রিকেট খেলার প্রতি এদেশের মানুষের আকর্ষণ ও উন্মাদনা চোখে পড়ার মতো। একসময় রাখাল ছেলেরা মাঠে গরু চরাতে গিয়ে ও স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা স্কুলে নানা ধরনের গ্রামীণ খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকতো। বর্তমানে শহরাঞ্চলে তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও খোলা জায়গা বা খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে অনেক গ্রামীণ খেলার মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। ফলে বর্তমানে ভিডিও গেম, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি প্রযুক্তিগত উপাদান গ্রামীণ খেলাধুলার স্থান দখল করে নিয়েছে। ছেলেমেয়েরা একটু সময় পেলেই মেতে উঠে এসব জিনিস নিয়ে।
পড়াশোনা যেমন ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশ ঘটায় তেমনি শারীরিক বিকাশ ঘটাতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে কাবাডি ও লাঠিখেলার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলতো। বিভিন্ন গ্রামে এসব খেলার জমজমাট আয়োজন হতো। এ সমস্ত খেলা দেখার জন্য অনেক দূরদূরান্ত থেকে খেলা শুরুর অনেক আগে থেকেই মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হতো খেলার মাঠে। অনেক নামিদামি খেলোয়াড় টাকার বিনিময়েও বিভিন্ন দলের হয়ে খেলতো। তাতে করে ভালো খেলে যেমন টাকাসহ নানারকম পুরস্কার মিলতো, সেইসঙ্গে ভালো খেলোয়াড় হিসেবে এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো তার খ্যাতি। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এ সমস্ত খেলোয়াড়দেরকে অনেক সম্মান করতো। আগেকার দিনে প্রতিবছর সব স্কুল, কলেজ, মাদরাসাগুলোতে নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোন খেলার মাঠও নেই। ফলে খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশ ঘটছে না। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের ফলে ছেলেমেয়েরা এখন ক্রমশ ক্রীড়াবিমুখ হয়ে পড়ছে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য এসব গ্রামীণ খেলাধুলা তো করেই না এমনকি এসব খেলাধুলার নামও জানে না। অথচ একসময় এসব খেলাধুলাকে বাদ দিয়ে বাঙালি ঐতিহ্যের পূর্ণতা কল্পনাও করা যেতো না। বর্তমানে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার প্রচলন না থাকায় গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো অচিরেই গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। পরিণত হবে রূপকথার গল্পে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন জয়নিউজকে বলেন, এখনও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিলে হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলোর বেশ কয়েকটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। এ সমস্ত গ্রামীণ খেলাধুলার সঙ্গে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাড়ির সম্পর্ক। তাই তাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের উচিত কিছুদিন পর পর এ সমস্ত গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর পরিচিতি তুলে ধরা ও তার সুফল লাভের জন্য আকৃষ্ট করা। বিদ্যালয়-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে এসব খেলা যুক্ত করা যায়। তাহলে হয়তো এসব খেলা হারিয়ে না গিয়ে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পরিচিত হয়ে উঠবে।
খেলাধুলা না করার ফলে শিশুদের শারীরিক সমস্যার ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজোয়ান রেহান জয়নিউজকে বলেন, শারীরিক কসরত না করলে শিশুদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা রোগ হতে পারে। ইতোমধ্যেই শিশুরা এসব মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ তারা নিয়মিত খেলাধুলা করে না। তারা স্মার্টফোন, ট্যাব ও কম্পিউটারে বেশি সময় কাটাচ্ছে। ফলে তাদের শরীরে মেদ জমা হচ্ছে। যার ফলে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো রোগ তাদের শরীরে বাসা বাঁধছে। অভিভাবকদের এসব ব্যাপারে এখনই সচেতন হতে হবে। তাদের সন্তানদের দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় খেলাধুলার জন্য নিশ্চিত করতে হবে। আর সেটা করা গেলেই আমরা একটি সুস্থ-সবল ভবিষ্যত প্রজন্ম পাবো।