মার্বেল খেলার খুব নেশা ছিল। একবার খেলা শেষ করে দুপুরে বাড়িতে খাওয়ার জন্য এসেছি। সাথে একটা ডিব্বা ভর্তি মার্বেল ছিল। ইতিমধ্যে আমার বাবাও দুপুরের খাবারের জন্য বাড়িতে এসেছেন। আমার মার্বেলের ডিব্বাখানা দেখে বাবার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল! খাওয়ার মধ্যেই উত্তম মধ্যম দেয়া শুরু করলেন। মা আমাকে উদ্ধার করে বাইরে বের করে দিলেন। আমারও সেইরকম মেজাজ উঠে গেল। ঘরের বাইরে যেয়ে বাবাকে একটা বাজে বকা দিলাম। বাবাও দমে যাবার নন। আমাকে ধরার জন্য দৌড়াতে লাগলেন, আমিও প্রাণপণে দৌড়ালাম।
তখন ছিল বর্ষাকাল। আমাদের গ্রামের পাশেই বিল। সেটা পানিতে টুইটুম্বুর ছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে সেই বিলে গিয়ে পড়লাম। আমার ধারণা ছিল বাবা এতটুকু আমাকে ফলো করবেন না। পেছনে তাকিয়ে দেখি বাবা আমাকে ধরার জন্য পানি পর্যন্ত নেমে গেছেন। আমি সাঁতার জানতাম না
বিধায় কিছুদূর যেয়েই থেমে গেলাম। বাবা আমাকে ধরে পানিতে চুবালেন আর বেলুন দিয়ে সমানে পিটালেন। আমি আধামরার মতো হয়ে গেছিলাম। গ্রামের লোকজন আমাকে উদ্ধার না করলে আমার অবস্থা কি হতো, জানিনা। পরে আমার বাবাই আমার চিকিৎসা করেছেন এবং সুস্থ্ করেছেন।
আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি তখন আমার সাথে আমার বড় ভাইও ছিলেন। যদিও বড়ভাই আমার দুইক্লাশ সিনিয়র ছিলেন। একদিন ক্লাশ চলছে, আমাকে আর আমার বড় ভাইকে হেডমাস্টারের কক্ষে ডেকে আনা হলো। আমাদের শরীরচর্চার শিক্ষক (কাসেম স্যার-কয়েক মাস আগে মৃত্যুবরণ করেছেন) কিছু না বলেই আমাদের দুই ভাইকে ভীষণরকম পিটানো শুরু করলেন। চার-পাঁচটি বেত এক করে পিটানো যাকে বলে। মারতে মারতে স্কুলের মাঠে নিয়ে আসলেন।
স্কুলের সকল ছাত্র/ছাত্রীরা ক্লাশ ছেড়ে বাইরে এসে লাইন ধরে আমাদের মারের দৃশ্য দেখতে থাকলো। অন্যান্য শিক্ষকগণ আমাদের বাঁচাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমরা মাটিতে পড়ে যাওয়া অবধি স্যার আমাদেরকে পিটালেন। আমার পড়নের কাপড় খুলে পড়ে গেছিল তখন। পরে জানতে পেরেছি, এই মারের পিছনে ছিল আমার বাবার নির্দেশনা। কি কারণে মার খেয়েছিলাম, তা আর মনে নেই এখন। আমরা দুই ভাই ভীষণরকম আহত হয়েছিলাম সেদিন। পরে বাবাই আমাদের চিকিৎসা করেছেন। এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে। সব ঘটনা এখন আর মনেও নেই।
আমার বাবা সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। ভীষণ রাগী, পরিশ্রমী আর একরোখা টাইপের মানুষ ছিলেন। মিথ্যা বলা ভীষণ অপছন্দ করতেন। যা বলতেন সাধারণত তাই করতেন। পড়াশোনা ছিল খুবই অল্প। বাবা ছোট থাকতেই আমার দাদা মারা যাওয়াতে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল তাঁর। সেরকম একটি বাস্তবতায় বোধকরি হাইস্কুল পর্যন্তও পড়েননি তিনি। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন। পড়াশোনা না করার ব্যাপারে কোনো অজুহাত তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। যে কারণে আমাদের পড়াশোনার মনোযোগ নষ্ট হয়, সেরকম কোনো বিষয়ে তিনি সবসময় ক্ষিপ্ত থাকতেন। সবসময় আমাদেরকে একটা পড়াশোনার পরিবেশে রাখতে চাইতেন। বাবা সবসময় বলতেন, “তোমাদের সর্বোচ্চ পড়াশোনার জন্য প্রয়োজন হলে আমি আমার ঘর-বাড়ি জমিজমা সব বিক্রি করে দিব, তাও তোমাদেরকে পড়তে হবে”।
আমার বৃত্তি পরীক্ষা, ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে আমার বাবা আমার সাথে থাকতেন। বাবা তাঁর ব্যবসার কাজে অনেক ব্যস্ত থাকলেও আমার জন্য চট্টগ্রাম আসতেও দ্বিধা করেননি। আমাকে দিনের পর দিন সময় দিয়েছেন আর উৎসাহ দিয়েছেন। এরকম একজন ব্যস্ত, রাগী ও একরোখা মানুষ যে কিভাবে আমার সাথে সময় দিয়েছেন, ভেবে পাইনা।
যখন বুঝতে পেরেছি, বাবার আবেগ অনুভূতিতে আমাদের জন্য কতটা ভালবাসা তাঁর ছিল, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা মুহূর্তে আমাদের জন্য বাবার যে কত টেনশান ছিল, আমাদের অনুপস্থিতিতে বাবা যে আমাদের জন্য কত চোখের জল ফেলতেন তা কখনোই আমাদেরকে বুঝতে দিতেন না। আমরা পাঁচ ভাই, দুই বোন। আমাদেরকে ভাল মানুষ হিসেবে বড় করার জন্য বাবা যে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন, টেনশন করে নিজের হৃৎপিন্ডের উপর চাপ নিয়েছেন, তা বুঝতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে।
১৯৯৭ সনের ৫ মে (সোমবার) দুপুর প্রায় ১২.৩০ টায় তাঁর নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। আমাদের ধারণা, বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। হাসপাতালে নেওয়ার মতো কোন সুযোগ পাওয়া যায়নি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন মাস্টার্সে অধ্যয়নরত এবং তখন আমি তৎকালিন ফরেস্ট্রি হোস্টেলে অবস্থান করছিলাম। শেলী (দীপের মা- সে এখন প্রয়াত) আমাকে বহু কৌশলে বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিল। তখন রাত প্রায় ২টা। পরদিন ৬ মে (মঙ্গলবার) সকালে বাবার দাফন সম্পন্ন করা হয় আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে।
আমরা পাঁচভাই, সবাই যার যার যোগ্যতায় ভাল অবস্থানে আছি। বড় ভাই ইতালির ভেনিসে আছেন পরিবারসহ, আমার ছোট দুইভাই সরকারি হাসপাতালে চাকরিরত। একজন পিজি হাসপাতালের সিনিয়র ফিজিওথেরাপিস্ট। আরেকজন ফার্মাসিস্ট। সবার ছোট ভাই একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সেলস ম্যানেজার হিসাবে আছেন। বোন দুইজন তাদের সংসার নিয়ে ভালই আছেন।
বাবা যদি এখনো বেঁচে থাকতেন, তাহলে তাঁর বয়স হতো প্রায় ৮২ বছর। আমাদের অবস্থান দেখে ভীষণ খুশী হতেন আর ভাবতেন তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছে। আর ভাবতেন আমাদেরকে শাষন করার জন্য, নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে রাখার জন্য, পড়াশোনার পরিবেশের মধ্যে রাখার জন্য যে ধরণের মারধর করেছেন, তা অর্থপূর্ণ হয়েছে। বাবা বেঁচে থাকলে সবাইকে বলে আত্মতৃপ্তি পেতেন যে, তাঁর ছেলে আজকে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর!
বাবার উপস্থিতি আমাদের জীবনে এতটাই অনবদ্য, অকাট্য ও অর্থপূর্ণ ছিল যে, কখনো ভাবিনি বাবা না থাকলে আমরা কিভাবে বাঁচব! কিন্তু পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রয়োজনটা এত জরুরি যে, আমরা ঠিকই জীবন চলার পথ বেঁছে নিয়েছি। বাবা মারা যাবার পর, একদিনও খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ করিনি। যখন অনুভব করেছি, বাবা, মার ঋণ পরিশোধের চেষ্টার সময় হয়েছে, তখন আর বাবা, মাকে পাইনি।
বাবা, তুমি কোথায় আছো জানিনা। তোমাকে আমরা যে কত ভালবাসি, তা তুমি নিশ্চয়ই জান। তোমার ২২তম মৃত্যুদিবসে তোমাকে শুধু এতটুকুই বলতে পারি, আমরা কেউ নষ্ট হয়ে যাইনি। তুমি যেরকম চেয়েছিলে আমরা হয়তবা সেরকমই হয়েছি। তোমার স্মৃতি এখনো আমাদের জীবনে ছায়ার মতো আকীর্ণ হয়ে আছে।