লোলিটাকে নিয়ে কিছু বলি। লোলিটাকে আমরা অনেকেই চিনি। অনেক অনেকবার দেখেছি তাঁকে খবরের কাগজে কিংবা সিনে ম্যাগাজিনের পাতায়। বিশাল আয়নার সামনে বসা একটি মেয়ে। পরনে শাড়ি। খোলা চুলে আলতোভাবে আঙ্গুল ছোঁয়ানো। ছিপছিপে গড়নের মেয়েটার চোখদু’টি যেন কথা বলে। এ দৃষ্টিতে আছে স্বপ্ন দেখার আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা।
ঢাকায় নির্মিত প্রথম ‘ছায়াচিত্র’র নায়িকা এই লোলিটা। ১৯৩১ সালে ঢাকার মুকুল (পরে আজাদ) প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় এ দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক ছবি ‘দি লাষ্ট কিস বা শেষ চুম্বন’। এর নায়িকা লোলিটা এবং এ দেশের সিনেমায় আসা প্রথম কোনো নারী।
এ ছবি নির্মাণের পেছনে ঢাকার নবাববাড়ির অবদানের কথা সবাই জানেন। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয় এই পথিকৃৎদের। ফটোগ্রাফিতে উৎসাহী নবাববাড়ির কয়েকজন তরুণ প্রয়াস পান এ ছবি নির্মাণে। তাঁদের যে ‘প্যাথে কোম্পানি’র ক্যামেরাটা ছিল, তা দিয়ে তাঁরা ছবি তোলার জন্য নামেন। পূর্ণাঙ্গ ছবি বানাবার আগে তাঁরা হাত পাকিয়েছিলেন ‘সুকুমারী’ নামের টেস্ট ফিল্ম বানিয়ে। সেটা ১৯২৭-২৮ সালের কথা। মাত্র ৩/৪ রিলের ছবি ছিল এটা। আর সুদর্শন তরুণ সৈয়দ আবদুস সোবহানকে সেদিন শাড়ি পরিয়ে ‘সুকুমারী’ তোলা হয়। ‘সুকুমারী’ কেবল নবাববাড়ির ভেতরেই প্রদর্শিত হতো।
‘দি লাষ্ট কিস বা শেষ চুম্বন’ ছিল ঢাকা ইষ্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটির নিবেদন। ছবির পরিচালক ছিলেন অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। এর আগে ‘সুকুমারী’ও বানিয়েছিলেন তিনি। অম্বুজ গুপ্ত ছিলেন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের শরীরচর্চার শিক্ষক। সে সময় ঢাকায় নাট্য পরিচালক হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম ছিল। নবাব পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তিনি এ ছবির পরিচালক ‘নিয়োগ’ হন। নির্মাতাগোষ্ঠী ঢাকার বাইরে কলকাতাসহ বৃহত্তর পর্যায়ে এ ছবি প্রদর্শনের কথা ভেবেছিল। তাই বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি সাব-টাইটেলে এ ছবি মুক্তি দেয়া হয়। ‘দি লাষ্ট কিস বা শেষ চুম্বন’ মাসব্যাপী সাফল্যের সাথে চলে। ছবির প্রথম শো’টা উদ্বোধন করেছিলেন ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার।
‘দি লাষ্ট কিস বা শেষ চুম্বন’-এ নায়িকা লোলিটার নায়ক ছিলেন খাজা আজমল। আর ভিলেন খাজা নসরুল্লাহ। ছবির কাহিনিটা এরকম: এক রাতে খাজা আজমল তার স্ত্রী লোলিটাকে নিয়ে যাত্রা দেখতে যাবার পথে জমিদার খাজা নসরুল্লাহর দল কর্তৃক আক্রান্ত হয়। অপহরণ করা হয় লোলিটাকে। কিছুদিন পর লোলিটাকে পাওয়া গেল জমিদারের বাড়িতে। সেখানে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। আর তাতে নায়ক-নায়িকার মৃত্যু হয়। সেকালে ধনী-জমিদারদের মধ্যকার নারী লালসা, লাম্পট্য- এ নিত্য সাধারণ ঘটনা এখানে মূর্ত। ঢাকার দিলকুশা গার্ডেন, শাহবাগ, নীলক্ষেত বাগিচা ও মতিঝিলে এ ছবির স্যুটিং হয়।
ছবির নায়ক খাজা আজমল ও ভিলেন খাজা নসরুল্লাহ সম্ভ্রান্ত গোত্রীয়। নবাববাড়ির লোক। খাজা আজমল তো সেকালে ঢাকার সুধীমহলে সংস্কৃতিসেবী-ক্রীড়ামোদি হিসেবে বেশ খ্যাত ছিলেন। ছিলেন কৃতী হকি ও ক্রিকেট খেলোয়াড়। ঢাকা বেতারের ঘোষক। বেতারে নাটকও করেছেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা বেতারের প্রথম উর্দু নাটকে কাজ করেন। ইতিহাস বলে, তিনিই প্রথম ঢাকায় মোটরগাড়ি আনেন। আর ঢাকায় অবতরণ করা প্রথম বিমানের অন্যতম আরোহী ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাভারে তিনি নিহত হন। আর খাজা নসরুল্লাহ এর আগে ‘সুকুমারী’তে নায়ক ছিলেন। কলকাতার নির্বাক ছবি দেবী চৌধুরাণীতে (১৯৩১) পুলিশের রোল করেছিলেন। তিনি পরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। একসময় ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যান হন এবং পাকিস্তান হবার পর কলকাতায় ডেপুটি হাই কমিশনার হন। ১৯৫৩ সালে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
তবে ছবির নায়িকা লোলিটার পরিচয় দেবার মতো ‘সম্ভ্রান্ত’ কোনো ছাপ ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন ‘সমাজের নীচুতলার বাসিন্দা, একজন পতিতা’। সে সময় ভদ্রঘরের কোনো মেয়েকে দিয়ে ছবিতে কাজ করানোর কথাটা মাথায় আনাও পাপ ছিল। তাই এ ছবিতে নায়িকা করার জন্য লোলিটাকে আনা হয় ‘পতিতালয়’ থেকে।
‘দি লাষ্ট কিস বা শেষ চুম্বন’ ছবির কাজ করতে সময় লেগেছিল এক বছর। ১৯২৯ সালের অক্টোবরে ছবির কাজ শুরু হয়। ১২ রিলের এ ছবি তৈরিতে সেদিন খরচ পড়েছিল ১২ হাজার টাকা। আর সেকালের ঢাকার সুধীজনেরা এ ছবির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ছবির বিভিন্ন কুশীলবের সাথে কথা হয়েছে সিনে লেখকদের। তাঁরা এই ছবি আর ছবির পেছনের অজানা অনেক তথ্যই দিয়ে গেছেন। কিন্তু লোলিটা বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানাতে পারেননি। সবাই শুধু এটুকুই জানিয়েছেন, ‘ছবির নায়িকা লোলিটাকে আনা হয় বাদামতলীর পতিতালয় থেকে। তার ডাকনাম বুড়ি। বয়স ১৪ বছর। ছবির কাজ শেষে বুড়ি তার পূর্বপেশায় ফিরে যায়।’ ছবির একটা দৃশ্যে নায়ক খাজা আজমল নায়িকা লোলিটার শাড়ির আঁচল ধরে টেনে তাকে (লোলিটা) ইজি চেয়ারে নিজের কোলে বসিয়েছিলেন- স্মৃতিচারণে এটুকু জানিয়ে গেছেন অনেকে। কিন্তু ইতিহাস বঞ্চিত হলো অনেক কিছু থেকে। যৌনপল্লীর বাসিন্দা বুড়ি কিভাবে এ ছবিতে যুক্ত হলেন, তা জানা গেল না। গুণিজনেরা শিল্পের খাতিরে হোক বা ব্যবসার প্রশ্নে তাঁর নামটি পাল্টে লোলিটা রেখেছিলেন। ছবির কাজ শেষে এই লোলিটা ফিরে গেলেন পূর্বপেশায়(!)। সত্যই কি তিনি ‘পূর্বপেশা’য় ফিরে গিয়েছিলেন! লোলিটা কোথায় ছিলেন, কেমন ছিলেন, কত বছর বেঁচেছিলেন বা তাঁর জীবনের শেষটা কেমন ছিল- ইতিহাস বঞ্চিত হলো এ পাঠ থেকে। এ দেশের সিনেমার প্রথম নায়িকাটি বঞ্চিত হলেন অনেক প্রাপ্তি থেকে। গুণিজনেরা তাঁর নাম বদলালেও, তাঁকে একটা ইতিহাসের সহযোদ্ধা করেও তাঁকে শিল্পীর মর্যাদাটুকু দেননি। ভাবতে অবাক লাগে, এই সুধী সমাবেশে থেকেও ‘অন্ত্যজ’ বলে মেয়েটি সমাদর পেল না। তাঁর সাথে কারো হৃদ্যতা হলো না। নয়তো কিভাবে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে আবারো অন্ধকার জীবনে ঠেলে দেয়া হলো! শুধু লোলিটা নয়, ছবির সহনায়িকা চারুবালাকে আনা হয়েছিল ‘কুমারটুলির পতিতালয়’ থেকে। ইতিহাস বলে, চারুবালাও ছবির কাজ শেষে যৌনকর্মীর পেশায় ফিরে যান। এঁদের জন্য কি সম্মানজনক কোনো বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেত না! ছবি শেষে কেউ আর তাঁদের খোঁজখবরও রাখলেন না। লোলিটা বা চারুবালারা হারিয়ে গেলেন চিরতরে। এখানেই উঠে আসে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা। প্রশ্নবিদ্ধ হয় মানবিকতা।
‘দি লাষ্ট কিস বা শেষ চুম্বন’ ছবির কোনো প্রিন্ট আজ নেই। শোনা যায়, কলকাতার অরোরা ফিল্মস মাত্র এক হাজার টাকায় হাতিয়ে নেয় এর প্রিন্ট। তাই ‘দি লাষ্ট কিস বা শেষ চুম্বন’ এর অস্তিত্ব বলতে এখন কেবল লোলিটার ওই একটা ছবিই। এ ছবির প্রসঙ্গ এলে বা এ নিয়ে লিখতে বসলে লোলিটার স্টিল ফটোটা সম্বল। লোলিটা একটা ইতিহাসের, একটা শিল্পের সতীর্থ হলেও তাঁকে শিল্পীর সম্মানটা দিতে কার্পণ্য ছিল সম্ভ্রান্তদের। তাঁকে কেবল ‘নীচুতলার বাসিন্দা’ হিসেবে ইতিহাসে বেঁচে থাকার ‘বিধান’ দিয়েছিলেন তাঁরা। অথচ আজকের দিনে লোলিটার ওই একটা স্টিল ফটোই জানান দেয়, ‘দি লাষ্ট কিস বা শেষ চুম্বন’ এর ইতিহাস অসত্য নয়। এ ছবির আর সব কুশীলব আজ ‘ছায়া’র মত মলিন। একমাত্র লোলিটাই বেঁচে আছেন ‘চিত্র’ হয়ে। বাস্তবতা এখানেই।