এখনও তাঁকে তাড়া করে বেড়ায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিভীষিকা। শরীরে আজও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন ৪০টি স্প্লিন্টার! ন্যাক্কারজনক গ্রেনেড হামলা মামলার ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে অন্যতম তিনি।
বলছিলাম ড. হাছান মাহমুদের কথা। বর্তমানে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন তিনি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হামলার সময় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সহকারী ছিলেন হাছান মাহমুদ।
হামলায় তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারান। এতে আহত হন শত-শত নেতা-কর্মী।
এ ঘটনায় আহতদের অনেকেই এখনও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। তেমনই একজন ড. হাছান মাহমুদ। গ্রেনেডের ক্ষত ও দুঃসহ কষ্টের সেই দিনটি তিনি এখনো ভুলতে পারেননি।
২১ আগস্ট উপলক্ষে জয়নিউজের পক্ষ থেকে কথা হয় হাছান মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রেনেড হামলার মুহূর্তে আমি দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার জন্য ট্রাকের উপর তৈরি মঞ্চের পাশেই ছিলাম। হামলা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাসহ আমরা মানবদেয়াল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষার চেষ্টা করি। এসময় শরীরে অসংখ্য গ্রেনেডের স্প্লিন্টার এসে বিদ্ধ হয়।
তিনি বলেন, আমাদের দলের দুই নারীনেত্রীর সহায়তায় কোনোভাবে একটি বাসে উঠেছিলাম। সেদিন আমাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। যখন আমি হাসপাতালের পথে তখন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মনে হচ্ছিল আমার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি আর এক ঘণ্টা দেরি হতো তাহলে সেদিন অন্যকিছু হয়ে যেতে পারত। হাসপাতালে ৮ দিন ভর্তি থাকার পর ২৯ আগস্ট উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে বেলজিয়ামে পাঠানো হয়। সেখানে কয়েকটি স্প্লিন্টার বের করলেও শরীরে এখনো ৪০টি স্প্রিন্টার রয়ে গেছে।
হাছান মাহমুদ বলেন, ৭৫’র ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পরবর্তীতে চার জাতীয় নেতা এবং সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা একইসূত্রে গাঁথা। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। শুধু হত্যার চেষ্টাই করেনি, ঘটনার পর জজ মিয়া নাটকের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রমকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছে। ন্যাক্কারজনক ওই ঘটনার জন্য জাতি তাদের ক্ষমা করেনি।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিনের একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। ছবিতে দেখা যায়, গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত ড. হাছান মাহমুদ রক্তে রঞ্জিত। তাঁর সারা শরীরে রক্ত ঝরছে। রক্তে লাল হয়ে গেছে পরনের শার্ট। কাঁদছেন হাছান মাহমুদ। খুলে গেছে শার্টের বোতাম। দলের নারীনেত্রী বর্তমানে ঢাকা জজকোর্টে আইনপেশায় নিয়োজিত অ্যাডভোকেট রুবিনা মিরা ও অপর এক নেত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রাজসাক্ষী হিসেবে ২০১৫ সালের ৪ মে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেন হাছান মাহমুদ।
ট্রাইব্যুনালের বিচারককে সাক্ষ্য প্রদানকালে তিনি বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল উদ্দেশ্য। ওইদিন বিস্ফোরিত গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টার আমার শরীরে ঢুকে যায়। চিকিৎসায় কিছু স্প্লিন্টার বের করা হয়। বাকি স্প্লিন্টারগুলো এখনো আমার শরীরে রয়ে গেছে। যেগুলো বের করতে গেলে আমার নার্ভ কেটে বের করতে হবে। ফলে আমার মৃত্যুও হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাকি স্প্লিন্টারগুলো বের করা হয়নি।
জানা যায়, ১৯৬৩ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাস গ্রামে জন্ম নেওয়া ড. হাছান মাহমুদ অনেক বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে আজকের অবস্থানে উঠে এসেছেন।
হাছান মাহমুদ চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাশ করে তৎকালীন ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে মহসিন কলেজ) ভর্তি হয়ে ওতপ্রোতভাবে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নির্বাচিত হন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে।
এরপর চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজকে নেতৃত্ব দেন হাছান মাহমুদ।
তিনি ১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন। রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন কিছুদিন। সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে যুক্ত হন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগে।
উত্তাল ছাত্ররাজনীতির পাঠ চুকিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে একসময় ইউরোপ চলে যান তিনি। ভর্তি হন বিশ্বের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ব্রিজ ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলসে। পাশাপাশি বেলজিয়াম আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। নির্বাচিত হন বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে।
ব্রিজ ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক স্টুডেন্ট ফোরামের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন আন্তর্জাতিক অঙ্গণে। এসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এরপর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে বিদেশে শিক্ষকতা ও নিরাপদ জীবনের চাকরি ফেলে দেশে ফিরে আসেন। এসেই জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির (২০০১ সাল) সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর যোগ দেন সভানেত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে। কিছুদিনের মাথায় আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সে দায়িত্ব পালন করেন ড. হাছান মাহমুদ। সভানেত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
এরপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে রাঙ্গুনিয়া থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন তিনি। বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী ও যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন তিনি।
পরে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও পরবর্তীতে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তিনি রাঙ্গুনিয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবার ড. হাছান মাহমুদকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।