সমাধিস্থল হলেও দর্শনার্থীদের স্বেচ্ছাচারিতায় পবিত্রতা হারাচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ওয়ার সিমেট্রি। এ স্থানটি এখন দর্শনার্থীদের জন্য রীতিমতো পার্ক! এখানে কিছু নিয়মকানুন থাকলেও বেশিরভাগ দর্শনার্থীই তা মানেন না।
নিত্যদিন স্কুল-কলেজ ও কোচিং ফাঁকি দিয়ে এখানে গোপন অভিসারে লিপ্ত হচ্ছে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা। এসব প্রতিরোধে সিমেট্রি কর্তৃপক্ষ পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা কামনা করছেন।
ওয়ার সিমেট্রি পরিচিতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থান ওয়ার সিমেট্রি। এটি চট্টগ্রাম নগরের অন্যতম নান্দনিক ও আকর্ষণীয় স্থানও বটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বিভিন্ন দেশের ৭৫৫ জন সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যদের সমাধি রয়েছে এখানে। যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১০টি ভিন্ন ভিন্ন ফোর্স বা বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেছেন।
বর্তমানে কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি কমিশন এটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে। নান্দনিক এ সমাধিস্থলটি দেখতে প্রতিদিনই এখানে ভিড় করে নগর ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা দর্শনার্থীরা। মাঝে মাঝে এখানে বিদেশি পর্যটকদেরও দেখা মেলে। কিন্তু বেশিরভাগ দর্শনার্থীই এখানকার নিয়মকানুন মানেন না বললেই চলে। ওয়ার সিমেট্রি এলাকায় বসা নিষেধ থাকলেও দর্শনার্থীরা প্রায়ই বসে পড়েন। বসেই ছবি তোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। সঙ্গে চলে হই-হুল্লোড়। এমনকি সবুজ ঘাসের উপর অনেককেই শুয়েও ছবি তোলতে দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়
সিমেট্রির কর্মচারীরা বারবার নিষেধ করলেও কেউ তাদের কথা শোনেন না। একস্থান থেকে তুলে দিলে তারা (দর্শনার্থী) অন্যস্থানে গিয়ে বসেন। সমাধিস্থলের মাঝখানে রয়েছে যীশু খ্রিস্টের একটি প্রতিকৃতি। এটির উপর জুতা নিয়ে বসে পড়েন অনেক দর্শনার্থী। এমনকি অনেকেই জুতা নিয়ে সমাধির উপর দাঁড়িয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি
ওয়ার সিমেট্রিতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। এদের অনেকেই জানেন না এটি সমাধিস্থল। সকাল-বিকেল, স্কুল-কলেজ-কোচিং ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে তারা এখানে মজা করতে আসেন। বিভিন্ন ধরণের খাবার খেয়ে তারা সমাধির আশপাশে খাবারের প্যাকেট ও পানির বোতল ইত্যাদি ফেলে চলে যান।
ছবি তুলতে প্রতিযোগিতা
এখানে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা তো আছেই। অনেকে প্রেমিক-প্রেমিকা নিয়ে এখানে সময় কাটাতে আসেন। অনেক সময় তারা অন্তরঙ্গ হয়ে যান। এমনকি প্রার্থনার জন্য বরাদ্দকৃত স্থানেও তারা অশালীন কার্যকলাপে লিপ্ত হন। অথচ একটি সমাধিস্থলে এ ধরণের কার্যক্রম নৈতিকতা বিরোধী।
কর্মচারী বলেন
ওয়ার সিমেট্রিতে কর্মরত মো. আলী নামে এক কর্মচারী বলেন, দর্শনার্থীদের নিষেধ করলে তারা শোনেন না। যেখানে-সেখানে তারা বসে পড়ে। অথচ এখানে বসা নিষেধ। আর সবাই মনে করে এটি একটি পার্ক। কিন্তু এটি আসলে একটি সমাধিস্থল। কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করা সবার দায়িত্ব।
তিনি বলেন, এখানে প্রেমিক-প্রেমিকারা অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে আসেন। কিছুদিন আগে এক প্রেমিক যুগল প্রার্থনার ঘরে অশালীন কার্যকলাপে লিপ্ত হন। বাধা দিলে উল্টো ছেলেটি আমাকে ধমক দেয়। যাদের নীতি-নৈতিকতা নেই তাদের আসলে এসব বোঝানো যাবে না। আর স্কুল-কলেজের উঠতি ছেলে-মেয়েদের কারণে আমরাও বিরক্ত। স্কুল-কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তারা এখানে ঘুরতে আসে।
দর্শনার্থীদের বক্তব্য
সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকালে নিজের মা ও ঢাকা থেকে আসা বড় বোনকে নিয়ে ওয়ার সিমেট্রিতে বেড়াতে আসেন পুলিশ কর্মকর্তা মো. ওয়াসিম। কিন্তু চারপাশে প্রেমিক যুগল ও টিনএজারদের হই-হুল্লোড় দেখে তিনি রীতিমতো বিস্মিত ও বিব্রত হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, মনে হচ্ছে কোনো পার্কে এসেছি। পার্কেও এত হই-হুল্লোড় হয় না। কবরস্থানের সামনে মানুষ এমন করতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। মা ও বোনকে এখানে এনে এখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। এরপর কিছুক্ষণ থেকে তিনি চলে যান।
দেখভাল যারা করেন, তারা কী বলছে?
বর্তমানে ওয়ার সিমেট্রিতে পাঁচজন কর্মচারী কাজ করেন। এখানকার সবকিছুই তারা দেখভাল করেন। তারা সবসময়ই চেষ্টা করেন দর্শনার্থীদের বোঝাতে। যাতে তারা কোনো কিছু না করে, করলে কবরস্থানের পবিত্রতা নষ্ট হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, খুবই খারাপ লাগে যখন দেখি কবরের উপর মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যীশু খ্রিস্টের ক্রসের উপর জুতা নিয়ে বসে যাচ্ছে। বসতে বারণ করলেও কেউ শোনে না। অথচ ফটকের সামনেই এখানকার নিয়মকানুন লেখা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা সমাধিস্থলটিকে সুন্দর ও পবিত্র রাখতে চাইলেও দর্শনার্থীদের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। বিদেশি অনেক পর্যটক এসব নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছে। এতে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে ওয়ার সিমেট্রি বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার মো. আবু সাঈদ জয়নিউজকে বলেন, সমাধিস্থল হলেও দর্শনার্থীরা এখন ওয়ার সিমেট্রিকে পার্ক বানিয়ে ফেলেছে। তাদের কার্যক্রমে আমরা খুবই বিরক্ত। বারবার মানা করা সত্ত্বেও তারা সমাধিস্থলের পবিত্রতা নষ্ট করছে। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দুঃখজনক।
তিনি বলেন, আমাদের লোকবল কম হওয়া সত্ত্বেও সবসময় দর্শনার্থীদের নজরদারির ভেতর রাখা যায় না। তবুও যেটুকু পারা যায় করার চেষ্টা করি। সবচেয়ে ভালো হয় যদি পুলিশ প্রশাসন মাঝে মাঝে এখানে টহলের ব্যবস্থা করে। তাহলে অনৈতিক কার্যকলাপ অনেক কমে যাবে। এছাড়া নিজেদের মূল্যবোধ উন্নত করাও জরুরি। সবার আগে মনে রাখতে হবে এটি একটি সমাধিস্থল। এটির পবিত্রতা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
প্রশাসন যা বলছে
পুলিশ টহলের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম জয়নিউজকে বলেন, সিমেট্রি কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা চায় তাহলে অবশ্যই আমরা সাহায্য করব।