সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার ঘটনার পরদিন সকালে ওসি প্রদীপ দাস অজ্ঞাত এক ব্যক্তিকে ফোন করে মামলা থেকে বাঁচার পথ খোঁজেন। এসময় ওসি প্রদীপ তার থেকে নানা পরামর্শ নেন— কীভাবে বাঁচবেন এই ঘটনা থেকে। ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সময় তার কন্ঠে সেনাবাহিনীকে নিয়ে ছিল ভয় ও উদ্বেগ।
এরকমই একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে গণমাধ্যমে। ফোনালাপে প্রদীপের কন্ঠের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলেও অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে শনিবার (৮ আগস্ট) বিমানবন্দরে র্যাব সদর দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট যে ফোনালাপ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা র্যাবের নজরে এসেছে। এ ফোনালাপের বিষয়টি আমরা যাচাই-বাছাই করছি। এছাড়া অন্য বিষয়গুলো বিস্তরভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
ঘটনার পরদিন সকালে ওসি প্রদীপ দাসের সঙ্গে অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির ফোনালাপটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
পরামর্শদাতা: হ্যালো
ওসি প্রদীপ: স্যার আদাব স্যার
পরামর্শদাতা: হ্যাঁ
ওসি প্রদীপ: স্যার আমি ওসি টেকনাফ প্রদীপ, স্যার
পরামর্শদাতা: হ্যা কি খবর প্রদীপ কোরবানির গরুর মধ্যে কি
ওসি প্রদীপ: স্যার একটা মহাবিপদে পড়ছি, আপনার সাহায্য দরকার
পরামর্শদাতা: বলো বলো
ওসি প্রদীপ: এখন আমরা স্যার একটা ১৫৩, ১৮৬ ও ৩০৭ এ মামলা নিছি স্যার
পরামর্শদাতা: ওয়ান ফিফটি থ্রি
ওসি প্রদীপ: স্যার থ্রি ফিফটি থ্রি
পরামর্শদাতা: থ্রি ফিফটি থ্রি সরকারি কর্মচারি আরেকটা হচ্ছে
ওসি প্রদীপ: আরেকটা হচ্ছে ১৮৬ পুলিশের কাজে বাধা
পরামর্শদাতা: আর্মিদেরকে ইন্টিমেশন দিছ কিনা?
ওসি প্রদীপ: এরপরে স্যার জানাইছি, আর্মি থেকে লোকজন আসছে
পরামর্শদাতা: এ কি আর্মির নাকি?
ওসি প্রদীপ: স্যার অবসরপ্রাপ্ত
পরামর্শদাতা: ও তাইলে এতো ডরের কি আছে?
ওসি প্রদীপ: এখন স্যার ও মারা গেছে, ইনজিওরড অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছে
পরামর্শদাতা: এর সঙ্গে যে লোকটা ছিল ওইটা কি?
ওসি প্রদীপ: ওইটা স্যার একটা ছাত্র, ইউনিভার্সিটির। সে বলছে যে তারা রাতের বেলা পাহাড়ের সিন নেয়ার জন্য আসছে।
ওসি প্রদীপ: ওরা নাকি ইউটিউবের একটা চ্যানেল করার জন্য আসছে ভ্রমণের উপরে।
পরামর্শদাতা: গাড়িওয়ালারে এরেস্ট করছ কিনা?
ওসি প্রদীপ: স্যার গাড়িচালক তো ও নিজেই
পরামর্শদাতা: ও আচ্ছা আচ্ছা, গাড়ি জব্দ করছ কিনা?
ওসি প্রদীপ: জি স্যার করছি
পরামর্শদাতা: আচ্ছা তোমরা যে বাধা দিছ, ওভারটেক করে গেছেক, এটার সাক্ষী আছে কিনা?
ওসি প্রদীপ: সাক্ষী আছে স্যার
পরামর্শদাতা: সাক্ষী থাকলে মামলা নিতে বলো
ওসি প্রদীপ: মামলা নিছি স্যার ১৮৬, ৩৫৩, ৩০৭
পরামর্শদাতা: প্রেয়ার দিয়া দিবা যে মার্ডার হইয়া গেছে
ওসি প্রদীপ: আরেকটা কেস দিতে হবে না স্যার?
পরামর্শদাতা: আরেকটা কেস নিবা?
ওসি প্রদীপ: আরেকটা কেস আমরা কি নিবো?
ওসি প্রদীপ: ও যে সদর হাসপাতালে মারা গেছে তাদের একটা কেস নিয়ে নিবো স্যার?
পরামর্শদাতা: আমার তো মনে হয় সদর থানার একটা কেস নিলে ভালো হয়
ওসি প্রদীপ: ভালো হবে না স্যার?
পরামর্শদাতা: আমার মনে হয় ভালো হয়। আর্মির লোক তো পরে টানাটানি করে কিনা!
ওসি প্রদীপ: নাহলে তো স্যার ওরা স্যার লাশ নিয়ে গেলে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।
ওসি প্রদীপ: আমরা একটা মামলা করে ফেললে ওই মামলাটা ট্যাগ করা যাবে।
পরামর্শদাতা: তাহলে তোমরা একটা কাজ করো না, ৩০৪ এও একটা মামলা নিয়া নিতে পারো।
ওসি প্রদীপ: ৩০৪ এ আমরা কি লিখবো স্যার?
পরামর্শদাতা: লেখবা যে হাউএভার মারা গেছিলো। এ কারণে মামলা করা হলো। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
ওসি প্রদীপ: স্যার ৩০৭ এ আসামির কলামে কি লিখবো?
পরামর্শদাতা: না আরেকটা সেপারেট মামলার জন্য বলছি। যেহেতু মারা গেছে তাই এ মামলা করা হলো
ওসি প্রদীপ: স্যার মামলা নিবো যে আসামির কলামে নাম লিখতে হবে না?
পরামর্শদাতা: পুলিশে গুলি করছিলো, বুজছি তো। এই এজাহারটা পুরা লিখবা, যে এই এই কারণে তাকে অবস্ট্রাকশন করে আটকানো হইছিলো। আটকানো হওয়ার পরে এই মামলা রজু হইছে। হাসপাতালে পাঠানোর পরে সেখানে সে মারা গেছে। যেহেতু মানুষ মারা গেছে তাই তদন্ত সাপেক্ষে মামলা রজু করা হলো, ৩০৪ এ
ওসি প্রদীপ: আসামি অজ্ঞাত
পরামর্শদাতা: এইটা করলে কোটে এইটা ট্যাগ হয়ে যাবে
ওসি প্রদীপ: স্যার ৩০৪ আমরা নিবো নাকি সেখানে ডিউটি থেকে নিয়ে নিবো?
পরামর্শদাতা: সদর থানায় হইবো নাকি মামলা?
ওসি প্রদীপ: সবকিছু লেখার পরে লেখবো যে মারা গেছে স্যার
পরামর্শদাতা: তোমার এজাহারটা হুবহু লেইখা যাইবা, যে এই এই মামলার আসামিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। যেহেতু মারা গেছে মামলা রজু করা হলো। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হোক
ওসি প্রদীপ: সবকিছু লিখে লাস্টে এটা লিখবো
পরামর্শদাতা: যেহেতু মারা গেছে মামলা রজু করা হলো। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাত্রে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোডে মেজর সিনহা তাঁর কক্সবাজারমুখী প্রাইভেট কারটি নিয়ে টেকনাফের বাহারছরা শামলাপুর পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের চেকপোস্টে পৌঁছালে গাড়িটি পুলিশ থামিয়ে দেয়। তখন তিনি উপর দিকে তার হাত তুলে তার প্রাইভেট কার থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে বাহারছরা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রর ইনচার্জ লিয়াকত আলী পরপর ৩ রাউন্ড গুলি করে হত্যা করে বলে সেনা সদর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়।
ঘটনা তদন্তে গত ২ আগস্ট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। ৪ আগস্ট থেকে তদন্ত শুরু হয়।
৫ আগস্ট দুপুরে দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১ ও ৩৪ ধারায় টেকনাফের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলাটি ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফ থানায় হত্যা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। যার মামলা নং সিআর-৯৪/২০২০।
আসামিরা হলেন- ওসি প্রদীপ ও আইসি লিয়াকত, এসআই নন্দলাল রক্ষিত, এসআই টুটুল, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা।
এ মামলায় সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের সঙ্গী ও ৩১ জুলাইয়ের ঘটনায় টেকনাফ পুলিশের দায়ের করা মামলার আসামি সাহেদুল ইসলাম সিফাতসহ ১০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।