বলুয়াদীঘির অভয়মিত্র মহাশ্মশান, নগরের সনাতন ধর্মালম্বীদের মরদেহ সৎকারের প্রধান স্থান। প্রতিদিন নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে মরদেহ নিয়ে আসেন স্বজনরা। তাই দিনভর এখানে থাকে আহাজারি। মুখাগ্নির পর এখানে শুধু একটি শরীরই নিঃশেষ হয়ে যায় না, শেষ হয়ে যায় একটি জীবনের গল্পও। শোকাহত স্বজনরা যখন ফিরে যান তখন সঙ্গে থাকে শুধুই ‘স্মৃতি’।
তবে স্বজনদের শেষ বিদায়েও যে দুর্বিষহ দুর্ভোগ পোহাতে হয় একটি ছবি ভাইরাল না হলে হয়ত তা অনেকেই জানতেন না।
সেদিন ছিল ১৯ আগস্ট। একটি লাশ নিয়ে এলেন স্বজনরা। কিন্তু বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। আর মহাশ্মশানে? বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানি মিলিয়ে অভয়মিত্র মহাশ্মশান তখন পানির নিচে!
শব দাহ করতে আগুন জ্বালাতে হবে। কিন্তু পানির নিচে আগুন জ্বালাবেন কী করে? কাঠের উপর কাঠ বসানো হলো, বেশ খানিকটা উঁচু করে লাশ উঠানো হলো চিতায়। আবর্জনায় ঠাসা কালো পানিতে দাঁড়িয়েই প্রস্তুতি নেওয়া হলো শেষ বিদায়ের।
গল্পটা এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গল্পটা এখানেই হারিয়ে যেতে দেননি আলোকচিত্র সাংবাদিক কমল দাশ। এই আলোকচিত্রশিল্পী অভয়মিত্র মহাশ্মশানে এসে নেমে পড়লেন পানিতে। এর পরের ইতিহাসটা কম-বেশি সবারই জানা।
শেষ বিদায়ে স্বজনদের দুর্ভোগের ছবিটি কমল শুধু তুললেনই না, আপলোড করলেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে। এরপরও কমলের মনে হলো, আরও কিছু করা প্রয়োজন। পানির নিচে দাঁড়িয়েই ফেসবুকে লাইভ ভিডিও শেয়ার করলেন তিনি।
মুহুর্তেই ওই ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ল দেশ-বিদেশে। সচেতন মহলে ভীষণ নাড়া দেয় ঘটনাটি। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে থাকে ক্ষোভ।
জনমনে সাড়া ফেলা ছবিটির নেপথ্যের কথা জানতে জয়নিউজ মুখোমুখি হয় আলোকচিত্র সাংবাদিক কমল দাশের। তিনি বলেন, বেলা সাড়ে ১২টার পর অনুজ বন্ধু সৌরভ প্রিয় পাল থেকে খবর পেয়ে মহাশ্মশানে যাই। তবে তখনও ভাবতে পারিনি পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ। নিজের ডিএসএলআর ক্যামেরাও সঙ্গে ছিল না। তাই মুঠোফোন নিয়েই কোমরপানিতে নেমে পড়ি। চিতার কাছে গিয়ে দেখলাম তখনও শবদাহ জ্বলছে। নোংরা কালো পানিতে শোকে স্তব্ধ স্বজনরা। হঠাৎ আমার প্রাণটাও হু হু করে উঠল। মনে পড়ে গেল হেলাল হাফিজের সেই বিখ্যাত কবিতার বইয়ের শিরোনাম ‘যে জলে আগুন জ্বলে’।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ কেমন জানি অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন কমল। তবে তা কয়েক সেকেন্ডের জন্য। এরপর নিজেকে সামলে বললেন, ছবি তুলে ফেসবুকে দেওয়ার আগে একটি লাইভ দিয়ে এ দুর্দশার চিত্র সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
কখন জানলেন ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে- প্রশ্ন করতেই বেদনায় ভরা মুখটা এবার স্বাভাবিক হলো। সাংবাদিক কমল বললেন, সত্যি বলতে কি আমি অনেক পরে জেনেছি।
এটি আমি শুধু পেশাগত কারণে করেছিলাম তা নয়। ঘটনাটি কতটা বেদনাদায়ক তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এরপরও ভালো লাগছে এই ভেবে, আমার ছবিগুলো ভাইরাল হওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের টনক নড়েছে। একইসঙ্গে প্রত্যাশা করবো, যাতে এ ধরনের ছবি আর কাউকে তুলতে না হয়- যোগ করেন কমল।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরে অমাবস্যা আর পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হতো মহাশ্মশান। বর্ষায় তা আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিতো। এরপরও বিষয়টিতে নজর ছিল না কোনো কর্তৃপক্ষের।