ট্রানজিট পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দর ও মোংলা বন্দর ব্যবহার শুরু করেছে ভারত। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে দ্রুত পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী এখন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক কয়েকটি চালান আসে দেশের এ দুই বন্দরে।
প্রথম চালানে চার কনটেইনার ট্রানজিট পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ে ‘সেঁজুতি জাহাজ। এরপর গত ৮ আগস্ট বাংলাদেশের জাহাজ ‘এমভি রিশাদ রায়হান’ যোগে ভারতের ট্রানজিট পণ্যের দ্বিতীয় চালান আসে মোংলা বন্দর দিয়ে।
সর্বশেষ বাংলাদেশ–ভারত ট্রানজিট চুক্তির আওতায় চালান নিয়ে গত মঙ্গলবার (৬ আগষ্ট) রাত আটটার দিকে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে পৌঁছেছে জাহাজ এমভি ট্রান্স সামুদেরা।
ট্রানজিট সহযোগিতার একটি মাধ্যম হলেও ব্যাপারটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক। সেজন্য ট্রানজিটকে বিবেচনা করতে হবে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবেই। এই নৌ-ট্রানজিট বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, কে কতটা লাভবান হবে- সেসব নিয়েই এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ট্রানজিট ব্যবহারে ভারতীয় এসব চালানে সরকার কি পেল?
জানা গেছে, রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী বেশ কয়েক ধরনের ধরনের মাশুল আদায় করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া কনটেইনার জাহাজ থেকে নামানোসহ কয়েক খাতে আরো মাশুল আদায় করেছে কাস্টমস।
প্রথম চালান : জানা গেছে, ভারতের শ্যামপ্রাসাদ মুখার্জি বন্দর (সাবেক কলকাতা বন্দর) থেকে উপকূলীয় নৌপথে রওনা দিয়ে পণ্যবাহী সেঁজুতি জাহাজটি ২০ জুলাই দিবাগত রাত ১টায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে।
২১ জুলাই মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে বন্দরের এনসিটি টার্মিনালের এক নম্বর জেটিতে নোঙর করে জাহাজটি। এই জাহাজে ট্রানজিট পণ্য ছিল চার কনটেইনার।
এসব পণ্য সড়কপথে লরি যোগে সরাসরি করিডোর সুবিধা নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় খালাস করে উত্তর-পূর্ব ভারতে পৌঁছে যায়।
এরমধ্যে দুই কন্টেইনারে আনীত ভারতের টাটা স্টিলের টিএমটি বার বা রড নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম ত্রিপুরার জিরানিয়ায়। অপর দু’টি কন্টেইনারে ভর্তি ডালের চালান পৌঁছায় আসামের করিমগঞ্জে।
চট্টগ্রাম বন্দর ও দেশের সড়কপথ ব্যবহার করে ভারতের ট্রানজিট পণ্যের প্রথম চার কনটেইনারের চালানে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম বন্দর—এই দুই সংস্থা সেবাবাবদ নানা খাতে প্রায় ৫৮ হাজার ৯শ টাকা বা ৬শ ৯৪ ডলার আয় হয় সরকারের। এ চালানে টনপ্রতি সরকারের আয় হচ্ছে ৫শ ৮৯ টাকা।
মাশুল ও মূল্য সংযোজন কর বাবদ চার কনটেইনার পণ্য থেকে ৩০ হাজার ৮শ ৯৯ টাকা বন্দরের আয় হয়েছে বলে জানায় বন্দর পর্ষদের সদস্য মো. জাফর আলম।
অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদেশ অনুযায়ী, প্রতি চালানের প্রসেসিং মাশুল ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট মাশুল ২০ টাকা, নিরাপত্তা মাশুল ১শ টাকা, এসকর্ট মাশুল ৫০ টাকা, কনটেইনার স্ক্যানিং মাশুল ২শ ৫৪ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক মাশুল ১শ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। সে হিসেবে চার কনটেইনারের ১শ টন পণ্যে ৩শ ৩০ ডলার বা ২৮ হাজার টাকা রাজস্ব পায় কাস্টমস বা সরকার।
এছাড়াও বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজে করে পণ্যগুলো আনা হয়েছে বিধায় ট্রানজিট পণ্য পরিবহনে সরকারের চেয়ে বেসরকারি খাতে আয় হয়েছে বেশি।
জাহাজ ভাড়া বাবদ এবং জাহাজ থেকে নামানোর পর বাংলাদেশের কনটেইনার পরিবহন বাবদ প্রায় ৩ লাখ টাকা আয় করার কথা বলেন পণ্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাঙ্গো লাইন লিমিটেড।
ট্রায়াল রানের দ্বিতীয় চালান আসে মোংলা বন্দর :
গত ৮ আগস্ট বাংলাদেশের জাহাজ ‘এমভি রিশাদ রায়হান’যোগে ভারতের ট্রানজিট পণ্যের দ্বিতীয় চালান আসে মোংলা বন্দর দিয়ে। এই চালানে আনা ১৬ দশমিক ৩শ ৮০ মেট্রিক টন লোহার পাইপ সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ে পৌঁছে যায়। তাছাড়া সাড়ে ৮ মেট্রিক টন প্লাস্টিকের কাঁচামাল কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থল সীমান্ত দিয়ে সরাসরি ট্রাকযোগে আসামে নিয়ে যাওয়া হয় পরদিনই।
জানা গেছে, জাহাজের আকার, পণ্যের ধরন ও ওজনের ওপর পোর্ট ডিউজ, রিভার ডিউজ, বার্থিং চার্জ, ল্যান্ডিং চার্জ, টাগ চার্জ, পাইলট চার্জ, পণ্য ওঠানামার লিপটন চার্জ ও আনবার্থ চার্জ নির্ধারিত হিসেবে ট্রানজিট পণ্য পরিবহন বাবদ আয় করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, মোংলা বন্দরের মাধ্যমে ভারতের সাথে পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক সৃষ্টি হলো।
ট্রানজিট চুক্তির সর্বশেষ চালানটি আসে চট্টগ্রাম বন্দরে :
বাংলাদেশ–ভারত ট্রানজিট চুক্তির আওতায় সর্বশেষ চালান নিয়ে গত মঙ্গলবার (৬ আগষ্ট) রাত আটটার দিকে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে পৌঁছেছে জাহাজ এমভি ট্রান্স সামুদেরা।
ট্রান্স সমুদেরা জাহাজের শিপিং এজেন্ট ম্যাঙ্গো লাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল সুজন ভূঁইয়া জানান, কলকাতা বন্দর থেকে মোট ১২৪ একক আমদানি পণ্য বোঝাই করে জাহাজটি রাত ৮টায় চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ে। এর মধ্যে একটি কনটেইনারে ট্রানজিট পণ্য আছে। বাকি কনটেইনারে পণ্যের আমদানিকারক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী।
বন্দর, কাস্টম এবং ট্রানজিটের চালান খালাস ও পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত শিপিং এজেন্ট সূত্রে জানা গেছে, জাহাজটি জেটিতে ভেড়ার পর প্রথমে ট্রানজিটের কনটেইনার পণ্য খালাস করা হয়।
এরপর প্রাইম মুভার ট্রেইলারে করে চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতের উদ্দেশে কাস্টমস কর্মকর্তাদের পাহারায় রওনা হন। এর আগে শিপিং এজেন্ট ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এর মাধ্যমে চালানের সব সরকারি মাশুল পরিশোধ করা হয়। এতে দেখা যায়, ছয় ধরনের ফি বাবদ কাস্টম পেয়েছে ৭ হাজার ৩শ টাকা।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কনটেইনারটি জাহাজ থেকে নামানো বাবদ শিপিং এজেন্ট থেকে মাশুল পেয়েছে ৪৩ ডলার বা ৪ হাজার ৮৫ টাকা। এ ছাড়া প্রায় ১ হাজার ৭শ ৫০ টাকা পণ্যের চালানের মালিকের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে।
শিপিং এজেন্ট থেকে যে মাশুল আদায় হয়েছে, তা সাধারণত পণ্য পরিবহনের ভাড়ার সঙ্গে আগেই আদায় করে নেওয়া হয়। এর বাইরে সড়ক বিভাগ সড়ক ব্যবহারের মাশুল পেয়েছে ১৫ হাজার ৮শ টাকা। সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৯শ ৩৫ টাকা পেয়েছে সরকারি তিন সংস্থা।
এ হিসাবে ট্রানজিটের চালানে সরকারের টনপ্রতি আয় ১ হাজার ১শ ৫৭ টাকা। কনটেইনারে পণ্য কমবেশি হলে টনপ্রতি মাশুলও কিছুটা কমবেশি হবে।
অন্যদিকে কলকাতা বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ভারতে নেওয়া পর্যন্ত চালানটিতে বেসরকারি খাত আয় করেছে প্রায় ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
উল্লেখ্য : ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’ চুক্তি এবং এই চুক্তির আওতায় তৈরি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুসরণ করা হচ্ছে।
এর আলোকে গত ২১ জুলাই থেকে ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের ট্রানজিট পণ্যবাহী কন্টেইনারের ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয়।
জেএন/পিআর