বাঙালি জাতির শোকের দিন ১৫ আগস্ট আজ। একদল বিপথগামী সেনাসদস্য ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে জয়নিউজের বিশেষ আয়োজনে আমরা তুলে ধরেছি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রয়াত নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কর্মকাণ্ড।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জাতির সংকটকালে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা যখন প্রতিবাদ করার সাহস দেখাননি, তখন চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করেছিলেন তৎকালীন শ্রমিক নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর সামরিক সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেছিলেন তিনি।
এজন্য বিদ্রোহের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তৎকালীন সরকার। সরকারের রোষানলে পড়ে এক পর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ভারতে পালিয়ে গেলেও সেখান থেকেই দলীয় কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তিনি। পরবর্তীতে দেশে ফিরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
প্রয়াত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর রাজনৈতিক সহকর্মী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। জীবিত অবস্থায় তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে কথা বলেন।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন,‘মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই জ্যেষ্ঠ নেতাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামে তরুণ-যুবকদের আরও একটি রাজনৈতিক ধারা সক্রিয় ছিল। তারা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনির অনুসারী। এই ধারার নেতারা মিলে ১৯৭১ সালে জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন। সেই জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন যুবনেতা মৌলভী সৈয়দ ও তৎকালীন শ্রমিক নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। আমি নিজেও ওই বাহিনীর সদস্য ছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই দুই নেতাই প্রথম প্রতিবাদের ডাক দেন এবং নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে থাকেন। এসময় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বড় কোনও অপারেশন করতে না পারলেও চট্টগ্রাম শহরে প্রায় প্রতিদিনই গ্রেনেড চার্জ করা হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসময় সামরিক জান্তা সরকার তাদের (মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরী) নামে হুলিয়া জারি করে। তখন তারা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। সেখানে থেকে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেন। ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরার সময় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান মৌলভী সৈয়দ। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হুলিয়া মাথায় নিয়ে ১৯৭৯ সালের শুরুর দিকে দেশে ফিরে আসেন মহিউদ্দিন ভাই।’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভূমিকা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারা আরও জানান, ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার দু’দিন পর আগ্রাবাদ সরকারি কমার্স কলেজের মাঠে এক বৈঠক ডাকেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। পরে মৌলভী সৈয়দ ও এস এম ইউসুফসহ চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-শ্রমিক লীগ নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে থাকেন।
তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তখন চট্টগ্রামে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল তাতে ভীত হয়ে তৎকালীন সরকার দমন-নীতি অবলম্বন করে। বিদ্রোহের অভিযোগে তখন তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে ওই মামলাগুলো একত্রিত করে একটি চার্জশিট প্রদান করা হয়। মামলাটিকে তখন সরকারের পক্ষ থেকে ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র’ মামলা বলে অভিহিত করা হয়েছে। মামলায় মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়।
ওই মামলার পর সরকারের দমন-পীড়নের এক পর্যায়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী ভারতে চলে যান। সেখান থেকে তিনি চট্টগ্রামে আন্দোলনকারীদের সংগঠিত করতে থাকেন। পরে তিনি (মহিউদ্দিন) কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করে কাদেরিয়া বাহিনীকে বৃহৎ পরিসরে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী এই বাহিনীর জোনাল কমান্ডার নিযুক্ত হন। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেট তার কমান্ডের অধীনে ছিল।
এরপর প্রতিরোধের জন্য দেশ থেকে লোকজন রিক্রুট করে ভারতে নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। প্রশিক্ষণ শেষে সশস্ত্র যোদ্ধাদের দেশের ভেতর পাঠিয়ে গেরিলা তৎপরতা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। পরে সেই চিন্তা থেকে সরে এসে দেশে ফিরে আসেন তারা এবং আবারও চট্টগ্রাম শ্রমিক লীগকে সংগঠিত করেন।
২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ৭৪ বছর বয়সে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।