মোবাইল দোকানের সেলসম্যান থেকে প্রভাবশালী ভিক্ষু!

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফেল করায় বিশেষ পদ্ধতিতে ভর্তি হয়েছিলেন ইসলামিয়া কলেজে। কিন্তু পরের বার আবার এসএসসি পরীক্ষায় ওই বিষয়ে ফেল করায় বন্ধ হয়ে যায় তার শিক্ষাজীবন। এরপর নিউ মার্কেট এলাকায় একটি মোবাইলের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করা শুরু করেন। কৌশলে রঙ কাপড় পড়ে ১৭-১৮ বছর পূর্বে দিল্লীতে পাড়ি জমান তিনি।

- Advertisement -

এরপর ভিক্ষু সেজে সেখানে জগৎজ্যোতি বিহারে আশ্রয় নেন। বিহারটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু ধর্মবীর পাল (রাজ্যসভার সদস্য) এর সাহচর্যে থাকার সুবাদে বিজেপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রী-এমপি এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র সঙ্গেও ছবি তোলার সুযোগ হয় তার।

- Advertisement -google news follower

সেই ছবিকে পুঁজি করে তিনি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গেও ছবি তুলেন। আর এসব ছবি তুলতে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা তাকে সহযোগিতা করেন। ঠিক এভাবেই হয়ে উঠেন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এরপর কাউকে মন্ত্রী, আবার কাউকে এমপি, কাউকে উপেজলা চেয়ারম্যান, কাউকে ক্রসফায়ার থেকে বাঁচানোর নামে টাকা আদায় করতেন তিনি।

এতক্ষণ যার কথা বলতেছিলাম, সেই ব্যক্তি হচ্ছেন রকি বড়ুয়া। যিনি নিজেকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’র এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দিতেন।

- Advertisement -islamibank

অবশেষে গত ১১ মে রাতে রকি বড়ুয়াকে নগরের মোহাম্মদপুর এলাকার নুর ম্যানশন ভবনের একটি বাসা থেকে ৫ সহযোগিসহ গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে লালখান বাজার এলাকায় মেরিন কে এইচ টাওয়ারে রকি বড়ুয়ার আরেক বাসায় অভিযান চালিয়ে তার কথিত রক্ষিতা এক নারীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব

মোবাইল দোকানের সেলসম্যান থেকে প্রভাবশালী ভিক্ষু!

গ্রেপ্তার হওয়া রকি বড়ুয়ার সহযোগিরা হলেন- সফিউল আজম শহীদ (৪০), ছগির আহমদ (৪০), রুবেল বড়ুয়া (২৭), সাইফুল ইসলাম প্রকাশ নয়ন (৩৮), নারায়ন মল্লিক (৩৪) ও শাহিনা ইসলাম প্রিয়া ওরফে আমেনা (২৪)।

অভিযানে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, ৬ রাউন্ড গুলি, ৩৫ লাখ টাকার টাকার এফডিআরের কাগজপত্র, ৬ বোতল বিদেশি মদ, বিদেশি সিগারেট, ১৩টি স্বাক্ষরযুক্ত ১০০ টাকা মূল্যের খালি স্ট্যাম্পসহ তার তদবির বাণিজ্য ও প্রতারণার কাগজপত্র জব্দ করে র‌্যাব।

রকি বড়ুয়াসহ গ্রেপ্তার ৭ জন ও পলাতক একজনের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে র‌্যাব-৭ এর ডিএডি মো. রুপ মিয়া চারটি মামলা করেছেন।

বিদেশি পিস্তল ও ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধারের ঘটনায় অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়েছে। অবৈধভাবে বিদেশি মদ রাখায় বিশেষ ক্ষমতা আইনেও একটি মামলা করা হয়েছে।

মোবাইল দোকানের সেলসম্যান থেকে প্রভাবশালী ভিক্ষু!

পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভুঁইয়া জয়নিউজকে জানান, দণ্ডবিধির ৪২০, ৪১৬ ও ৫১১ ধারায় আরও একটি মামলা হয়েছে রকি বড়ুয়া ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে। ওই মামলায় সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে ছবি তুলে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখানো, বেকার যুবকদের চাকরি দেওয়ার নাম করে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরসহ বিভিন্ন ব্যাংকের চেক গ্রহণ ও যোগদানপত্র দিয়ে প্রতারণা করা বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

এছাড়া দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতকে তোয়াক্কা না করে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বেআইনি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুক্ত করার লক্ষ্যে গোপন বৈঠকের ঘটনায় রকি ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে ৬(২), ৮, ৯, ১০ ও ১২ ধারায় একটি মামলা করা হয়েছে।

যেভাবে উত্থান রকি বড়ুয়ার
বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে জগৎজ্যোতি বিহারে আশ্রয় নেন তিনি। বিহারটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু ধর্মবীর পালের (রাজ্যসভার সদস্য) সঙ্গে বিজেপির খুব সম্পর্ক ছিল। বিহারে রকি বড়ুয়া ছিলেন ধর্মগুরুর অন্যতম প্রিয় একজন। বিজেপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বিহারে আসতেন। ধর্মগুরুর ভালোবাসার সুযোগে রকি বড়ুয়া সবার সঙ্গে ছবি তোলা এবং তাদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে ধর্মগুরুর রেফারেন্সে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন রকি বড়ুয়া। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তৎকালীন বিজেপি সভাপতি (বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) অমিত শাহসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেন এবং ছবি তুলেন।

মোবাইল দোকানের সেলসম্যান থেকে প্রভাবশালী ভিক্ষু!

বাংলাদেশে এসে সেই ছবিগুলোকে পুঁজি করে ব্যবসা শুরু করেন রকি বড়ুয়া। প্রচার করতে থাকেন দিল্লীর রাজ্য সরকার থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার- সবার সঙ্গে তার দহরম-মহরম, অন্তরঙ্গতা। সেগুলো শুনে এবং দেখে এলাকার লোকজন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অনেকেই সমীহ করতে থাকেন রকি বড়ুয়াকে। তিনি ভারতের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে থাকেন। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলেন। সেসব ছবি আবার ভারতে দেখিয়ে বলতেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা তার কথা শুনেন। এভাবে উত্থান ঘটে নকি বড়ুয়ার।

নয়াদিল্লিতে রমরমা অফিস:
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে রকি বড়ুয়ার বড় অফিস রয়েছে। যেখান থেকে তার এই অপকর্ম পরিচালিত হতো। বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতা সেখানে যেতেন। রকি বড়ুয়া তাদের খুব যত্ন করতেন এবং ধর্মগুরুর সেই রেফারেন্সে বারতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। এসব দেখে বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতারা খুশি হয়ে যেতেন এবং রকি বড়ুয়ার উপর বিশ্বাস করতে থাকতেন।

মোবাইল দোকানের সেলসম্যান থেকে প্রভাবশালী ভিক্ষু!

রকি বড়ুয়ার অফিসে গিয়েছেন এমন একজন রাজনৈতিক নেতা জয়নিউজকে বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আমি ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে দিল্লিতে রকি বড়ুয়ার অফিস ও তার কর্মকাণ্ড দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। পরে আমার থেকে কিছু টাকাও নিয়ে ছিল সে। কিন্তু এসব কথাতো সবাইকে বলা যায় না।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে ছবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবি, বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে সুসম্পর্ক পুঁজি করে মনোনয়ন নিয়ে দেওয়ার আশ্বাসে রকি বড়ুয়া তার পেছনে ঘুরিয়েছেন অন্তত ডজনখানেক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে। এজন্য কারো কারো কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা গ্রহণেরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাবে চলতো বৈঠক
রকি বড়ুয়া চট্টগ্রামে থাকাকালীন নিয়মিত রাতে চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাবে বিভিন্ন জনের সঙ্গে বৈঠক করতেন। গভীর রাত পর্যন্ত চলা এসব বৈঠকে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, কিছু পত্রিকার শীর্ষস্থানীয় কর্তা, আওয়ামী লীগ নেতা, বিএনপির নেতা ও নগর ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনসহ অনেকেই থাকতেন। এভাবে চলতো আড্ডা। সেখানে সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় এবং অনেক পাওয়া না পাওয়ার কথা আলোচনা হতো। এছাড়া কিভাবে কাকে পদ পাইয়ে দিতে হয়, কাকে মন্ত্রী বানানো হবে এসব নিয়ে আলোচনা হতো। আড্ডায় রকি বড়ুয়া এমন ভাব করতেন, মনে হতো সে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারক ফোরামের কেউ!

সাঈদীপুত্রের সঙ্গে বৈঠক
গত ১ এপ্রিল মধ্যরাতে লকডাউন পরিস্থিতিতে লোহাগাড়ার চরম্বা ইউনিয়নের বিবিবিলা বড়ুয়া পাড়ায় এসে রকি বড়ুয়ার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন যুদ্ধাপরাধে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর পুত্র মাসুদ সাঈদী, মাওলানা তারেক মনোয়ার ও কয়েকজন জামায়াত নেতা। বিতর্কিত তারেক মনোয়ার এবং সাঈদীপুত্রের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সহায়তায় সাঈদীকে মুক্তির বিষয়ে রাতভর বৈঠক করেন রকি বড়ুয়া। তারা রকির বাড়িতে রাতে খাওয়া-দাওয়া করেন এবং বৈঠক শেষে সকাল ৮টায় সড়ক পথে ঢাকায় ফিরে যান। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সঙ্গে তোলা বৈঠকের ছবি পোস্ট দেন রকি বড়ুয়া।

রকি বড়ুয়ার সঙ্গে যাদের সখ্যতা তারাও নজরদারিতে
রকি বড়ুয়ার সঙ্গে যারা ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় বৈঠক করেছেন তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূইয়া জয়নিউজকে বলেন, রকি বড়ুয়ার বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। আমরা সব বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে সামনের দিকে এগুচ্ছি। তদন্তের পর সব বেরিয়ে আসবে।

জয়নিউজ/এসআই
KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM