দেশে ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ ঘোষণা হলেও ২২ বছরে তা বাস্তবায়ন হয়নি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেন। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ বিষয়ে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী আজ মঙ্গলবার থেকে দেশের কোনো সুপারশপে পলিথিন ব্যাগ রাখা যাবে না। এর পরিবর্তে পাট বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। ১ নভেম্বর থেকে ঢাকার ১০টি কাঁচাবাজারে পলিথিন ব্যবহার বন্ধে কার্যক্রম শুরু হবে। দেশব্যাপী পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সুপারশপগুলোর পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে, ক্রেতারা যেন নিজস্ব ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটা করতে আসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সুপারশপগুলো নিজেদের মতো প্রস্তুতি নিয়েছে। পলিথিন বা পলিপ্রপাইলিন এমন কোনো ব্যাগই তারা ব্যবহার করবে না।
গত ৯ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় পলিথিন ব্যাগ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না। একই সঙ্গে ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। ওই দিন বিভিন্ন সুপারশপের প্রতিনিধি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তখন থেকেই সুপারশপগুলো ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে।
সুপারশপের আউটলেটের ম্যানেজাররা জানান, তারা এরই মধ্যে শপের বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। তাদের যে টিস্যু ব্যাগ, জালি ব্যাগ ছিল সেগুলো সরিয়ে নিয়েছে। পরিবেশ অধিদফতর থেকে পাটের তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ব্যাগ দেওয়া হচ্ছে। যার মূল্য ৬টা থেকে ১৭ টাকা পর্যন্ত। কাস্টমারদের সেগুলো কিনে নিতে হবে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী বলেন, আমরা এখন থেকে কাপড়ের ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করব। তবে গ্রাহকদের নিজস্ব ব্যাগ নিয়ে আসার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যত তাড়াতাড়ি ক্রেতারা নিজেদের অভ্যাস পরিবর্তন করবেন, তত তাড়াতাড়ি আমাদের কাজ করা সহজ হবে।
এরই মধ্যে দেশের অন্যতম বড় সুপারশপ স্বপ্নর পক্ষ থেকে গ্রাহকদের মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়ে পলিথিন ব্যাগ সরবরাহ না করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। খুদেবার্তায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, আজ মঙ্গলবার থেকে স্বপ্নে বাজার করতে নিজের পরিবেশবান্ধব ব্যাগ নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করছি। আপনি চাইলে সুলভমূল্যে স্বপ্ন থেকেও এই ব্যাগ কিনতে পারবেন।’ অর্থাৎ গ্রাহকরা পরিবেশবান্ধব ব্যাগ না নিয়ে গেলে, পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে স্বপ্ন ব্যাগ বিক্রি করবে। এছাড়া আগোরা, ইউনিমার্ট, মিনা বাজার, প্রিন্স বাজারসহ ঢাকার সুপার শপগুলো তাদের ফেসবুক পেইজে নিষিদ্ধ পলিথিনের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ না ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে।
পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। প্রচারণা চালিয়েছেন মোহাম্মদপুরের টাউন হল কাঁচাবাজারেও। সচেতনতা বাড়াতে নিষিদ্ধ পলিথিনের বিকল্প পণ্যের মেলারও আয়োজন করা হয়।
গত রোববার পরিবেশ অধিদপ্তরে পলিথিনের বিকল্প পণ্যের মেলায় উঠে আসে পরিবেশবান্ধব নানা পণ্যের সমাহার। সুপারশপে পলিথিন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং এসপিদের পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিন ব্যাগ বন্ধে নির্দেশনা দিয়েছেন উপদেষ্টা। তিনি পলিথিনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বলেন, ‘প্লাস্টিক পলিথিনের অপ্রতিরোধ্য ব্যবহার পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মাটির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে, নদী-নালা ও জলাশয় দূষিত করছে এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এসব কারণে প্লাস্টিক পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে সব পর্যায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’
রিজওয়ানা বলেন, পলিথনের যে কোন ধরনের ব্যাগ ও প্লাস্টিক যে ফর্মেই তৈরি হোক না কেন তা সহজে পচে না। এই ব্যাগ ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হলে মাটির সঙ্গে মিশতে সময় নেয় প্রায় সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ বছর। এমনকি মাটির অনেক নিচে গেলেও তা ধ্বংস করছে মাটির স্বাভাবিক স্তরকে। পলিপ্রোপিলিন ব্যাগে থাকা রাসায়নিক পদার্থ মাটির জীব, গাছ, মাটির উর্বরতা, কৃষি উৎপাদনশীলতা সব কিছু ধবংস করে।
বাজার মনিটরিং ও বিকল্প দুটিকেই গুরুত্ব দিয়ে উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসান বলেন, আগেও পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ অনেকখানি সফল হয়েছিল শুধু বাজার মনিটরিংয়ের কারণে। আর পলিথিনের বিকল্প নিয়েও কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশে সব সময়ই পলিথিনের সুস্পষ্ট বিকল্প ছিল। এখন পাট, কাপড় ও কাগজকে বিকল্প হিসেবে রাখা হয়েছে। প্লাস্টিক বা পলিথিনের মত দেখতে পচনশীল ব্যাগকেও বিকল্প হিসেবে আপাতত ভাবা হচ্ছে না।
এদিকে নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধের সিদ্ধান্তকে অনেকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মাঈশা সুপার শপের সত্বাধিকারী আলম বলেন, ‘আমরা পলিথিন বন্ধের সিদ্ধান্তে খুশি। পলিথিনের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হলে আমাদের ঝামেলা কমে যাবে। এখন ক্রেতারা বাজারের সময় ব্যাগ নিয়ে আসেন না। এতে প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য আমাদের আলাদা পলিথিন ব্যবহার করতে হয়। এতে আমাদের খরচ বাড়ে। তাই অন্তর্বতীকালীন সরকারের পলিথিন বন্ধের সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। আমি বিষয়টি জানার পর থেকে নতুন করে পলিথিন ক্রয় করিনি।
মাঈশা সুপার শপে বাজার করতে আসা ক্রেতা আব্দুর রহমান বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধ করে আইন হয়েছে ২০০২ সালে। কিন্তু সেই আইন আলোর মুখ দেখেনি। তাই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হোক এটাই প্রত্যাশা আমাদের।
অন্যদিকে বিকল্প হিসেবে ভিন্নধর্মী ও সৃজনশীল উদ্যোগ যেমন ঝুট কাপড়ের ব্যাগ, মোম দিয়ে আবরণ দেওয়া কাগজ, মোটা ব্রাউন পেপার, টিনের ঝুড়ির মত বিকল্পের কথা বলেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ অনুবিভাগ) ফাহমিদা খানম। তিনি বলেন, বিকল্প ব্যাগটি সহজে ব্যবহার করা যাচ্ছে কি না এবং এটি তৈরির উপকরণ বাজারে সহজলভ্য কি না; সেটিকে গুরত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যাগের দাম বাড়বে না।
এদিকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন তাঁরা উপদেষ্টাকে জানিয়েছিলেন, পণ্যের প্যাকেজিংয়ে প্লাস্টিকের উপযুক্ত বিকল্প না থাকায় পাটের ব্যাগ চালুর কার্যক্রম বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং। তাই প্যাকেজিংয়ের জন্য পাটের ব্যাগের চাহিদামতো সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
তখন এম সাখাওয়াত বলেছিলেন, ‘সারা দেশে পাটের প্রচলন বাড়াতে হবে। আগামী মাস (অক্টোবর) থেকে দেশের সুপারশপগুলোতে পাটের ব্যাগ চালুর কার্যক্রম নিয়েছে সরকার। এ মন্ত্রণালয় সে লক্ষ্যে কাজ করছে। আমি চাই, দেশের সবাইকে নিয়ে একযোগে এ কার্যক্রম সফল করতে। এতে করে দেশে পাটের অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়বে।’
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘পাটের মোড়কের আইনের বাস্তবায়ন আরো আগে শুরু হওয়া উচিত ছিল। তাহলে এত দিনে পলিথিন ও প্ল্যাস্টিকের উপযুক্ত বিকল্প পাওয়া যেত। পাটের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে বহুমুখী পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে।’
দেশে কবে পলিথিন নিষিদ্ধ হয়?
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর বিধান অনুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০২ সালের ১ মার্চ বিএনপি সরকার দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারপর পেরিয়েছে ২২ বছর। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এরপর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শাসন করেছে। তবুও আইন থাকা সত্ত্বেও দেশে পলিথিন ব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়নি। পলিথিন ব্যবহার কমার বিপরীতে সুপারশপ থেকে সবখানেই বেড়েছে পলিথিনের ব্যবহার। ২০০২ সালের পর ফের গতকাল থেকে সুপারশপে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে শঙ্কায় ক্রেতা-বিক্রেতারা।
জেএন/এমআর